নতুন বছরে পড়া প্রথম বইয়ের অনুভূতি
- Rashef Mahbub
- Jan 9, 2023
- 3 min read
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার প্রচুর খ্যাতি শুনে থাকলেও দু’একটা ছোট গল্প বাদে তাঁর উপন্যাস আমার আগে পড়া হয়ে ওঠে নি। দিন দুয়েক হল “আদর্শ হিন্দু হোটেল” উপন্যাসটা শেষ করলাম। গল্পের মাঝে অসংখ্যবার নিপুণহাতে বর্ণনাকৃত হিন্দু হোটেলের লুচি, সন্দেশ, মাছের মুড়োর মতই এর স্বাদ বহুদিন মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে লেগে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই; তবে রিভিউ লিখতে যতটুকু মনে থাকা প্রয়োজন ততটুকু হয়তো থাকবে না। পরের অংশে কিছু স্পয়লার থাকছে, তাই বই পড়া না হলে ও পথ না মাড়ানোই ভাল।
এই গল্পের প্রধান চরিত্র হাজারি ঠাকুর একজন সামান্য রাঁধুনি বামুন, সাত টাকা মাইনেতে যে বেচু চক্কোতির বহু পুরনো হোটেলে কাজ করে। হাজারি ঠাকুর সে যুগের বেশিরভাগ উপন্যাসের প্রটাগনিস্টের মতই নির্যাতিত, অবহেলিত ধাঁচের ভাল মানুষ চরিত্র হওয়ায় অসম্ভব সুন্দর লেখনীর মাঝেও মনে একটা খটকা জেগেছিল, “আচ্ছা, সেই চিরচেনা প্যাঁচালী”। কিন্তু এইখানেই বিভূতিভূষণ বাজিমাত করেছেন। এই উপন্যাসে অনেক, অনেকবার তিনি আমাদের চিরচেনা পথে হাঁটিয়েছেন, কিন্তু গন্তব্য যেয়ে শেষ হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন কোনখানে, অসম্ভব সুন্দর কোন স্থানে। হেঁয়ালি না করে এবার উদাহরণে আসা যাক।
প্রথমত, সাধারনত অবহেলিত নির্যাতিত চরিত্রের ছবি আঁকার সময় গল্পকার তাকে প্রতি পদে, সম্ভব-অসম্ভব প্রতিটি মানুষের দ্বারাই নির্যাতিত হতে দেখাতে থাকেন। এখানে মোটেও তেমনটা ঘটে নি। হাজারি ঠাকুরের নির্যাতনের বারো আনাই পদ্ম ঝিঁর কাছ থেকে আর সিঁকিভাগ হয়তো বেচু চক্কোতির ব্যবহারে জোটে, এর বাইরে হাজারি ঠাকুরকে আর প্রায় সবাই ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে এবং সবচে, বেশি যেটা করে তা হচ্ছে বিশ্বাস। ভালোমানুষি এবং রন্ধন, এই দুই শিল্পে হাজারি ঠাকুরের যে অবয়ব, তা বাস্তব ধরাধমে খুব একটা চোখে পড়ে না বললেই চলে। দ্বিতীয়ত, কুসুম, অতসী থেকে শুরু করে একাধিক কমবয়স্ক বা মেয়ের বয়সী মেয়েদের সাথে হাজারির অসাধারণ সখ্যতা গল্পে দেখানো হয়েছে চমৎকারভাবে। সাধারণত উপন্যাসে এইসব অসম বয়সী সম্পর্কগুলোর দেখা দিলে বেশিরভাগ ঔপন্যাসিক কোন একদিক থেকে জিনিসটাতে একটা রোম্যান্টিক ধাঁচ টেনে আনেন, এই গল্পেও যার টেনশান ভালমতই ছিল। পদ্ম ঝিঁ দুয়ো দিচ্ছে, পুলিশে যা তা বলছে, এমন অনেক ঘটনায় সেসব টানাপড়েন এসেছে, কিন্তু বিভূতি অত্যন্ত দক্ষতার সহিত মূল চরিত্রগুলোকে এই কাঁটাময় পথের মধ্য দিয়ে অক্ষত অবস্থায়ই হাঁটিয়ে নিয়ে গেছেন। গল্পের কোথাও তাই হাজারি, কুসুম বা অতসীর মনে পরস্পরের প্রতি রোম্যান্টিক আবেগের সৃষ্টি হয় নি, নিখাদ এবং নির্লোভ শ্রদ্ধা এবং স্নেহময় ভালবাসাই বরং বারবার ফিরে এসেছে।

তৃতীয়ত এবং সবচে’ বড় যেই ইউনিক ব্যপারটা বলব, এই গল্পের প্রায় তিনভাগের একভাগ শেষ করে ফেলার পরও বেশিরভাগেরই মনে হবে হাজারীর আদর্শ হিন্দু হোটেল দেওয়া আর বুঝি হবে না; এও হয়তোবা অতি ভালমানুষি প্রটাগনিস্টের অপূর্ণ স্বপ্ন আর বার বার জীবনযুধে হেরে যাওয়ার গল্প। নতুবা এতবার এতগুলো মানুষ হোটেল দেওয়ার টাকা সাধলেও কেউ এভাবে ফিরিয়ে দেয়? কিন্তু আবারও বিভূতি এখানে তার সম্পূর্ণ নিজস্বতায় আমাদের টেনে নিয়ে গিয়েছেন সেই জগতে, যেখানে হাজারি আসলেই আদর্শ হিন্দু হোটেল দিয়ে ফেলে। শুধু তাই নয়, সে হোটেল বাদেও ট্রেন স্টেশানের হোটেলের চুক্তি থেকে শুরু করে একেবারে কলকাতার বড় হোটেলের চাকরি, সব একে একে তার আগের সেই অনাড়ম্বর জীবনে ঘটতে থাকে। মেয়েকেও সে বিয়ে দেয় যে ছেলেকে দেখে জামাই বানাবে ভেবেছিল তার সাথেই, আবার পদ্ম ঝি আর বেচু চক্কোতির নির্যাতিত কাজের লোক থেকে সেই হয়ে যায় মনিব।
এই উপন্যাস সহ পুরনো বিখ্যাত লেখকদের লেখাতে আরেকটা যে ব্যাপার বেশ ভাল মত লক্ষ্যণীয় তা হচ্ছে গল্পের টেনশান, টুইস্ট বা ট্র্যাজেডির চাহিদাতেও তাদের প্রটাগনিস্ট খুব সহজে ক্যারেক্টার ভেঙ্গে ফেলে না, যেটা আধুনিক লেখকদের গল্পে খুব বেশি দেখা যায়। প্রয়োজনের মুহুর্তে, অপমানের মুখে নায়ক হঠাৎ করে কোথা হতে যেন পুরো আলাদা মানুষ হয়ে যায় যা অনেক ক্ষেত্রেই খুবই সিনেমাসুলভ এবং অবাস্তব লাগে। কিন্তু এখানে এমনকি কুসুমের অপমানেও, নিজের চুরির অপবাদেও হাজারি প্রচণ্ড মনঃকষ্ট হয়তো পেয়ে থাকে, কিন্তু তবু তার প্রতিবাদের ভাষা সেই আমতা আমতা, ভেঙ্গে ভেঙ্গে ভয়ে ভয়ে বলা নিচু কণ্ঠস্বরেই। এমনকি মনিব হওয়ার পরও বেচু চক্কোতি বা পদ্ম ঝিঁর সাথে তার ব্যবহার সেই চিরচেনা হাজারিসুলভ। আমার নতুন বছরে পড়া প্রথম বই হচ্ছে এই আদর্শ হিন্দু হোটেল। বছরের শুরুতে মন ভাল করে দেওয়ার জন্য বিভূতিভূষণকে মন থেকে প্রণাম।
Comments