অমানুষ
- Rashef Mahbub
- Jul 1, 2022
- 5 min read
ফরিদপুরের মধুখালি উপজেলার অজপাড়া এক গাঁয়ে এক ছেলের মাথায় হঠাৎ একবার শিং গজালো। ছেলেটার নাম রজত, মেথরপট্টির একেবারে দিন আনে দিন খায় টাইপ পরিবারে জন্ম। রজতের বয়স তখন ষোল, সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর বিকালে এক-দেড় ঘন্টা ক্রিকেট খেলে সে মেথরপট্টির বাকি ছেলেদের সাথে। দিনের সেই সময়টুকুতে ওর মনে হয় জীবন বুঝি এতটা নিষ্ঠুর কোন কিছু নয়। সেদিনও ক্রিকেট খেলে গোসল করে এসে ভাঁজা পেয়াজ-মরিচের সাথে এক সানকি ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছিল রজত। কিন্তু রাত একটু গভীর হতেই শুরু হল প্রচণ্ড মাথাব্যাথা। আসমান জমিন এক করা ব্যাথা যাকে বলে। রজত সারারাত ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে ভোরের দিকে একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেল। সকালে ঘুম ভাঙতে সে আবিষ্কার করলো মাথা ব্যাথা নেই, কিন্ত মাথা বেশ ভারি ভারি লাগছে। মেথরপট্টির বস্তির বাড়িগুলোতে মুখ ধোয়ার সময় কেউ আয়না দেখে না। তাই কাজে বেরোনোর আগে তড়িঘড়ি করে পান্তা খেতে বসার মুহূর্ত পর্যন্ত সে জানতে পারলো না তার মাথার ডানদিকের একটা বেশ বড় অংশ বেঢপ ফুলে উঠেছে।
পান্তা বেড়ে দিতে এসে রজতের মা লক্ষ্মী চীৎকার করে উঠলো “হারামজাদা আবার খেলতে যাইয়া ব্যাথা পাইছিস? কুত্তার বাচ্চা শিক্ষা হই নাইক্যা তোর?”
রজত অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। কাল কেন, গত কয়েকদিন খেলতে যেয়েই সে কোথাও কোন ব্যাথা পায় নি। বোন সরস্বতীর কাছ থেকে তার ছোট্ট ভাঙা আয়নাটা ধার করে এনে সে দেখলো আসলেই তো, মাথার এক কোণে বেশ বড়সড় ভাবে ফোলা। কদিনের মধ্যে সেই ফোলা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল, মাথার সেই জায়গা থেকে অনেক খানি চুলও পড়ে গেল। গুলশানের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকা কোন ছেলের এমন হলে তারা হয়তো ছেলে নিয়ে ততক্ষণে সুইজারল্যান্ড-আমেরিকা ছুট লাগাতো। মেথরপট্টির বেশিরভাগ মানুষের চার-পাঁচটা করে ছেলেপুলে। সবার মুখে সবদিন খাবার জোটে না। সেখানে কারো গুরুতর অসুখ বিসুখ হওয়া মানে এক-দুদিন একটু কম কাজ করা। এরপরও না সারলে বাজারের কোণে পরেশদার ফার্মেসীতে ঢুঁ মারা। সে যা দেয় চোখবুজে তা খেয়ে আল্লাহ্-খোদা বা ভগবানের নাম জঁপা। রজতও তাই করলো, কিন্তু কাজ হল না কিছু তাতে। মাসখানেকের মধ্যে রজতের মাথার ফোলা জায়গাটা পুরোপুরি একটা শিং এ রূপ নিল।
মেথরপট্টি সহ গোটা ফরিদপুরে ব্যাপারটা ছড়িয়ে যেতে সময় লাগলো না। লোকাল পত্রিকায় সেসময় বেশ কয়েকটা নিউজ হয়ে গেল। রজত রীতিমত ছোটখাটো সেলিব্রেটি হয়ে গেল। কিন্তু তাতে তার মন্দ বই ভাল হল না। মেথরপট্টির সবাই তাকে ভয়ের চোখে দেখতে লাগলো। বন্ধুরা তাকে দেখলে অনেকেই ছুটে পালায়, তার এত সাধের ক্রিকেট খেলাও বন্ধ হয়ে গেল। মেথরপট্টির বেশিরভাগের ধারণা হল রজত মানুষ না। অতি উৎসাহী কেউ কেউ রজতের শিং-এর এলোমেলা রেখাতে আল্লাহু, ওম ইত্যাদি লেখা খুঁজে পেল বা খুঁজে পেয়েছে বলে ছড়াতে লাগলো। এর মধ্যে একদিন মধুখালি বাজারে বিএনপি-আওয়ামী লীগের পোলাপানের র্যান্ডম গোলাগুলির একটা এসে লাগলো রজতের শিং এ। শিং-এর মাথার এক পাশ উড়ে গেল কিন্তু রজতের কিছুই হল না। এলাকার লোকের এবার ধারণা আরও বদ্ধমূল হল রজত মানুষ না। রজতের নিজের বাবা মা ভাই বোন সুদ্ধে ওর থেকে যথাসম্ভব দূরে দূরে থাকতে লাগল। শেষের দিকে রজতের মাথা ব্যাথাও প্রচণ্ডভাবে বাড়ত। বেচারা রাতের বেশিরভাগ সময় কাটাত না ঘুমিয়ে। সব যন্ত্রণার সমাপ্তি হল অবশেষে একদিন। বাড়ির পাশের শিমুল গাছে এক ভোরবেলা ঝুলে পড়লো ছেলেটা। সকালে যখন ওকে পাওয়া গেল, কোন এক অদ্ভুত কারণে ওর শিং-এর গোড়া দিয়ে তখনও গড়িয়ে গড়িয়ে রক্ত পড়ছে।
গল্প শেষ করে পুরো ক্লাসের দিকে তাকালো প্রফেসর নুরুল হুদা। আর্লি থার্টিতেই লোকটা সাইকোলজির প্রফেসর হয়ে বসে আছে। কিন্তু তার ক্লাসের বেশিরভাগ সময় কেটে যায় এইসব হাবিজাবি গল্পতে। নুরুল হুদার গলার স্বর চমৎকার, গল্প বলেনও খুব সুন্দর ভাবে। তাই ছাত্রছাত্রীরাও গভীর মনোযোগে তা শোনে সবসময়। আর না শুনেই বা উপায় কি? দেশের ভার্সিটিগুলোতে প্রফসর ক্লাসে এসে যা খুশি করুক, তা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন অপশন তো নেই। কতজন তো না পড়িয়ে আরো কত বালছাল কাজ করে। নুরুল হুদা নাহয় অদ্ভুত উদ্ভট কিছু গল্পই করলেন।
এই গল্প থেকে কি বুঝলে তোমরা? চোখ নাচিয়ে ক্লাসের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন তিনি। এরপর নিজেই উত্তর দিতে লাগলেন। এর থেকে বোঝা যায়, এই পৃথিবীর মনুষ্য সমাজ, যারা নাকি বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে ভরপুর, তারা ছকে বাঁধা জগতের ম্যানুয়ালের বাইরের কোন কিছুকেই গ্রহণ করে না, জায়গা দেয় না, টিকে থাকতে দেয় না। দুটো হাত, দুটো পা, চোখ, ঠোঁট, কান; একদম সেইম সেট থাকা লাগবেই। এর বেশি কম হলে কেউ মানুষ না। পশু, জীন, ভূত, পিশাচ; আরো কত কি। রাস্তায় হিজড়াদেরই দেখো না। এরা হাসিমুখে তোমাদের কাছে দুটো টাকা চাইতে আসলেও তোমরা এমন কাঁচুমাচু হয়ে যাও যেন এরা অস্পৃশ্য, এদের ছুলে তোমাদের দু-একটা অঙ্গ খসে পড়বে।
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে তার গলায় অসম্ভব তিক্ততা ঝড়ে পড়লো। বিরক্ত হয়েই কিনা, পাঁচ মিনিট আগেই তিনি ক্লাস শেষ করে দিলেন।
ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সিফাত আসিফকে জিজ্ঞেস করলো, এই নুরুল স্যারের সমস্যা কিরে? প্রতিদিন এইসব কি গল্প শুরু করে? একদিন কোন মেয়ের চোখ নাকের নিচে, আরেকদিন কোন পোলার মাথায় শিং গজাইসে। এইগুলা কই পাই ব্যাটা?
কেন তুই শুনোস নাই উনারে নিয়ে গুজব?
নাহ্, কি গুজব।
উনার নাকি এক বোন আছে বাসায়। সারাদিন বাড়ির ভেতরে থাকে, কথা বলতে পারে না। ঐ মহিলার নাকি কান নাই।
কান নাই মানে? একটা কান নাই নাকি একেবারেই নাই?
শুনছি একেবারেই নাই। আমি তো আর দেখে আসিনি।
কি অদ্ভুত কথা। এই গুজব তোরে কে বলল?
আমারে বলসে ফাহিম, কিন্তু আসলে কে দেখসে জানি না।
তোর একবারও মনে হয় নাই জিনিসটা ভেরিফাই করা দরকার?
না, আমার বাড়া এত তেল নাই। তোর কথা শুনে আগেরবার অনেক প্যারা খাইয়া সেই পুরান পত্রিকা খুঁইজা বের করসি ঐ নাকের নিচে চোখ আলা মেয়ের কথা। আর প্যারা নেয়ার ইচ্ছা নাই। নুরুল স্যারের বোনের কান না থাকলে নাই, তাতে আমার কি?
বলে আসিফ উঠে দাঁড়াল। তুই থাক, আমার একটু দিনার সাথে দেখা করতে হবে।
একটা বিড়ি দিয়ে যা।
বিড়ি ধরিয়ে সিফাত চিন্তিত মুখে সাইকেলে উঠলো। কথা বলতে পারে না, কান নাই, সত্যি হয়ে থাকলে কি অদ্ভুত এই মহিলার জীবন। আর কাহিনী সত্যি কিনা তাই বা কে জানে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল মিথ্যা গুজব ফলানোর একেবারে উর্বর ভূমি। কিছুদিন আগে কোন এক কারণে এক স্যার খোঁড়ায় খোঁড়ায় হাঁটা শুরু করলে গুজব রটে গেল তার নাকি বাসার আলমারি গায়ের উপর পড়ে এক বিচি গলে গেছে। যত্তসব আজাইরা।
সিফাতের বাড়ি থেকে নুরুল হুদার বাড়ি খুব বেশি হলে সাইকেলে মিনিট সাতেক হবে। ঐদিকটায় সিফাত প্রায়ই আড্ডা দেয়,তখনই নুরুল হুদাকে কয়েকবার তার বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে। শহর এলাকায় এরকম একতালা বাড়ি খুব কমই দেখা যায় আজকাল। সিফাত সিদ্ধান্ত নিলে সে এই গুজবটার শেষ দেখে ছাড়বে। বাড়িটার পাঁচিল বেশি উঁচু না, টপকানো একদমই ইজি হবার কথা। এরপরও নুরুল স্যার দেখে ফেললে বলবে দরজা খোলা ছিল, উনি যে ক্লাস প্রজেক্টে একজন “অস্বাভাবিক” মানুষকে নিয়ে এনালাইসিস করতে বলেছেন, তার বোনের কথা শুনে একারণেই ওর এ বাড়িতে আসা।
চেনা চায়ের দোকানে সাইকেল তালা দিয়ে রেখে বাকিটা সিফাত হেটে আসলো। বাড়ির সামনের দরজার উলটা দিকেই বেশ কিছু দোকান রয়েছে, এদিকটায় তাই ভালোই মানুষজনের আনাগোনা। সিফাত ঘুরে বাড়ির পেছনে চলে গেল। এদিকটায় পেছনে ময়লার বিশাল ট্যাংক রাস্তা থেকে বাড়ির পাঁচিলকে অনেকটাই আড়াল করে রেখেছে। চারপাশ দেখে নিয়ে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকলো সিফাত। আলো জ্বলা একটা একটা জানালা পেরিয়ে পৌঁছল লিভিং রুমের জানালার ধারে। জানালাটা অনেকটাই ভেজানো, খুব সামান্যই দেখা যাচ্ছে। তবে ওটুকুই যথেষ্ট। নুরুল স্যারকে না দেখা গেলেও তার বোনকে দেখা যাচ্ছে। খুব সম্ভবত নুরুল স্যার তাকে খাইয়ে দিচ্ছেন চামচে করে স্যুপ জাতীয় কিছু। সিফাত আরো কাছে গিয়ে একেবারে জানালার শিকে নাক ছুঁইয়ে ফেললো। ইয়েস! এইতো! ওহ মাই গড। মহিলার আসলেই কান নেই। কি যে অদ্ভুত লাগছে তাকে দেখতে। পাশে বসে নুরুল স্যার অদ্ভুত মমতায় তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। মহিলার চোখের দৃষ্টি ভাবলেশহীন। মানুষের চোখে অনেক কথা ধরা পড়ে, উনার চোখ দেখে কিচ্ছু পড়া যাচ্ছে না।
নুরুল হুদা বোনের মুখ মুছিয়ে পানি খাইয়ে জিনিসগুলো পাশের টেবিলে রাখলো। যা দেখার তা দেখে ফেলেছে, এবার দ্রুত কেটে পড়া দরকার, এই ভেবে সিফাত জানালা থেকে সড়ে পড়তে যাবে এইসময় অদ্ভুত একটা জিনিস দেখে ও চোখ বড় বড় করে আবার জানলার সিকে নাক ডোবালো। নুরুল হুদা বোনের সামনে এসে জামা-কাপড় খুলে পুরো উলঙ্গ হয়ে গেলেন। এরপর তার বোন হা করলো, হাঁ টা বড় হতে থাকলো, কোন মানুষের পক্ষে এত বড় হা করা সম্ভব না। নুরুল হুদা বোনের হা করে রাখা বিশাল মুখগহ্বরে তার মাথা ঢুকিয়ে দিলেন। এরপর ঢুকিয়ে দিলেন পুরো শরীর। পুরো ঘটনা এত দ্রুত ঘটে গেল, সিফাতের মনে হল সে যেন স্বপ্ন দেখছে। এরপরের দৃশ্য দেখে মনে হল এরা এই পৃথিবীর কোন অংশ নয়। নুরুল হুদার বোনের মাথার দুই পাশের চামড়া আসতে আসতে বাইরে বেরোতে শুরু করল। সে এক বীভৎস দৃশ্য। প্রায় একমিনিটের মত মাথার দুইপাশের চামড়ায় ব্যাপক পরিবর্তন হল। আসতে আসতে সেখান থেকে বেরিয়ে এল দু’টা কান। একদম মানুষের মত দুই কান। শুধু কানের একদম ওপরে মানুষের চোখের মত কি যেন, এতদূর থেকে সিফাত বুঝতে পারলো না। বিস্ময়ে বোবা সিফাত উপলব্ধি করল নুরল হুদা স্যারের বোনের কান নেই একথা সত্যি না। তার কান আছে। তার সেই কান আর কেউ না, নুরুল হুদা স্যার নিজে।
হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে ছেলে-মেয়ে মিশ্রিত গলায় ভেসে এল, “জানলার ধারে এটা কে রে? শুয়োরের বাচ্চা সাহস থাকলে ভেতরে আয়।”
Comments