বাগানবিলাস
- Rashef Mahbub
- Oct 13, 2022
- 3 min read
১
এমন অদ্ভুত রঙের গোলাপ জাহিদ কখনো দেখে নি। ফুলের দোকানের সামনে প্রচুর ভীড় দেখে সে কৌতুহলে থেমেছিল, এবার কারণটা বুঝতে পারল। কালো-হলদু মিশ্র রঙের গোলাপ, গাড় নীল থেকে হাল্কা হতে হতে আকাশী শেডের পাপড়ি ওয়ালা গোলাপ থেকে শুরু করে অদ্ভুত ইউনিক রঙের নানা ধরণের ফুলে দোকানটা ভরা। হুবহু বেলী ফুলের মত একটা ফুল দেখা যাচ্ছে, গন্ধটাও তেমনই, কিন্তু রঙ গাঢ় রক্তবর্ণ। রজনীগন্ধা স্টিক দেখা যাচ্ছে নীল-সাদা-হলুদ রঙের মিশ্রণের, পানির বালতিতে ডোবানো রংধনুর মত লাগছে একসাথে স্টিকগুলোকে। তের-চৌদ্দ বছরের বাচ্চা একটা ছেলে ফুল বিক্রি করছে। ভীড় করা ক্রেতারা ছেলেটিকে প্রথমদিকে একগাদা প্রশ্ন করছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারল ছেলেটা বোবা। ফুলের দোকানের দুইপাশে বড় করে প্রিন্ট করে প্রত্যেকটা ফুলের দাম লেখা। বেশিরভাগ ফুলের দামই অন্যান্য দোকানের থেকে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু ফুলের রঙগুলো এত সুন্দর এবং ইউনিক যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দোকান খালি হয়ে গেল।
২
তোর ভাগ্য তো মেলা ভালা বেটা। যেই বন্যা হইতেসে, আইজকায় পাইসি তিনডা। সামনে কয়দিন আরো মেলাডি পাবি। দেহ্, একটা বিড়ি দে।
বলতে বলতে একটা কাপড়ের ব্যাগ এগিয়ে দিল সুভাষ। পাশেই বেশ বড় একটা মেডিকেলের ডোমের কাজ করে সে। বিলাল কাপড়ের ব্যাগটার ভিতরে রাখা আরেকটা পলিথিন ব্যাগ একটু টিপ দিয়ে দেখল।
সবগুলান মাইয়া তো?
হরে বেটা। কইবার কইবি এককথা। দেহ, টেকাডা দে।
বন্যায় তাইলে সমানে মরতাসে? টাকা দিতে দিতে প্রশ্ন করল বিলাল।
হহ্, লাশ চেনাও যাইতেসে না অনেকের। মর্গ এম্নেও ভইরা গেছে, গণকবর দিতে হইতেসে সব।
বেটা এত যখন মাল, দামডা একটু কম রাখলে তো পারিস।
বিড়িতে কষে একটা টান দিয়ে তিক্ত স্বরে বলল বিলাল।
হালারপুত, কত্তজনরে টেকা দিতে হয় তোর এই বাল করতে জানস? নিজের তো বালডাও থাহে না।
৩
বাসায় ফিরে বিলাল দেখল হুসেন ভাত খাচ্ছে কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে। সাথে টকে যাওয়া ডাল।
কিরে বেটা আমারে ছাড়াই শুরু কইরা দিছস।
হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে ভ্রু নাচাল বিলাল।
হুসেন হাসলো। ইশারায় পাশের থালা দেখাল।বিলালের জন্য সব বেড়েই খেতে বসেছে সে। চার বছর বয়সে এক বাস এক্সিডেন্টের পর থেকে আর কথা বলতে পারে না হুসেন।
দুই ভাই শুধু মরিচ-পেয়াজ আর নষ্ট ডাল দিয়ে দুই থালা ভাত শেষ করে ফেলল।
আনছিস তো আইজকা?
হুসেন হাসিমুখে মাথা ঝাঁকাল। উঠে গিয়ে একটা বক্স এনে দিল সে। বক্সটা খুলেই হাসি ফুটলো বিলালের মুখে।
সাবাশ বেটা। দাম পড়সে, কিন্তুক ভাল জিনিস আনছস।
হুসেন হাসিমুখে ভাইয়ের প্রশংসা গ্রহণ করল।
আর বেশিদিন না বুঝলি। বন্যায় সমানে মানুষ মরতাসে। লাশের দাম যাইবো কইমা। আর কয় মাস যাইতে দে, পাশের জমিডাও কিন্যা লমু। তহন আর এই মরিচ-পিয়াজ খাইতে হইবো না বেডা।
হুসেনের মাথা নেড়ে আদর করে দিল বিলাল। যাহ্, নতুন চারাগুলান লইয়া যা বাগানের ধারে আর বেডগুলান খুইড়া রেডি কর।
হুসেইন উঠে চলে গেল দ্রুত পায়ে। বিলাল এবার ব্যাগ থেকে পলিথিন খুলে তিনটা হাত বের করল। দুইটা মেয়ের হাত ধবধবা ফর্সা, একটা একটু কাল। সুভাষ হাতগুলো কাটার সময় ধুয়েই দিয়েছে। বিলাল আবার সেগুলো ভাল করে ধুয়ে মুছে নিল। এবার হুসেনের আনা নেলপালিশের বক্সটা খুলল সে। একটা হাত কোলের উপরে তুলে নিয়ে নেলপালিশ লাগাতে থাকলো সে নিপুণ হাতে। সবগুলো হাতে নেলপালিশ লাগানো হয়ে গেলে সেগুলো নিয়ে চলে গেল বাগানে। হুসেনের দু’চোখ ঘুম ঘুম। সারাদিনের ফুল বেঁচাকেনা আর এখন মাঝরাতে এই খোঁড়াখুঁড়িতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিলাল তাকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিল। এরপর একটা একটা করে খোঁড়া তিনটা গর্তে হাতগুলো লম্ব বরাবর রাখলো সে। হুসেন একটা গোলাপ, একটা গাঁদা আর একটা টগর ফুলের বেশ বড়, ফুল ফুটবে ফুটবে করছে চারাগাছ এনে রেখেছে পাশেই। একটা একটা করে চারাগাছ বেশ যত্নের সাথে লাগিয়ে দিল বিলাল। তারপর বিড়বিড় করে মন্ত্রের মত কিছু আওড়ে ফু দিল পাশে রাখা মগের পানিতে। এরপর মগের পানি সদ্য লাগানো তিনটা গাছের গোঁড়ায় ঢেলে দিয়ে উঠে পড়লো সে। অনেক রাত হয়েছে, তার নিজেরও ঘুম ঘুম চাপছে।
৪
জাহিদ প্রায় দুই সপ্তাহ পর আবার ফুলের দোকানটা খোলা পেল। সেদিন প্রিয়তীর জন্য কালো-হলুদ গোলাপ আর রক্তবর্ণ বেলী নিয়ে যাওয়ার পর সে এমন খুশি আর অবাক হয়েছে যে জাহিদ ভেবেছিল পরদিন আরো কিছু নতুন ফুল নিয়ে তাকে চমকে দিবে। কিন্তু এরপর প্রতিদিন এই পথ দিয়ে গেলেও দোকান বন্ধ পেয়েছে সে। আজকে আবার সেই ভিড় দেখা যাচ্ছে, বোবা ছেলেটা ফুল বেঁচতে বেঁচতে হাঁপিয়ে উঠেছে। আজকে সবুজাভ বা কিছুটা টারকোয়েজ রঙের গোলাপ, নীলচে গাঁদা আর বেগুনী রঙের টগর ফুল কিনছে সবাই হুড়াহুড়ি করে। জাহিদও ভীড় ঠেলে দ্রুত সামনে এগিয়ে গেল। ফুলগুলো পাওয়ার পর প্রিয়তীর বিস্ময় মেশানো হাসিখুশি চেহারাটা কল্পনা করেই ওর অন্যরকম এক আনন্দের অনুভূতি হল।
Comments