ভর্তাবিলাস
- Rashef Mahbub
- Jan 19, 2023
- 8 min read
“এই বাল দেখানোর জন্য তুই আমাকে সাত কিলোমিটার হাঁটাইলি?”
কথাটা মনে হয় না রফিকের কানে ঢুকলো। সে এমনভাবে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে ও যেন গাছ না, নীল শাড়ি পড়া নীলা কে দেখছে। নীলা রফিকের প্রথম প্রেম।
একদল লোক লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গাছটার একটা করে পাতা নিয়ে চিবুচ্ছে, সাথে একটা কি সরবত টাইপ জিনিস একঢোঁক খেয়ে বাতাসে প্রণাম করতে করতে চলে যাচ্ছে। কুৎসিত একটা দৃশ্য। মনে হচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষের বিবর্তন কোনভাবে গরুর সাথে ক্রসওভার করেছে। সরবত টাইপ যেই জিনিসটা খাচ্ছে সেইটাও দেখতে জন্ডিস রোগীর প্রসাবের মত হলুদ।
রফিকের পিড়াপীড়িতে আমরাও লাইনে দাঁড়িয়ে সেই বাল গাছের পাতা আর হলুদ সরবত খেলাম। ফেরার পথের সাত কিলোমিটার রফিকের বকবকানিতে আমার কান ভনভন করতে লাগলো।
“ইথিওপিয়ার রাজধানীটা কি বলে ফেল দেখি এবার?”
“ আচ্ছা, বাদশাহ্ আলমগীর কবিতাটা মনে আছে? বল কোন ক্লাসে ছিল আর কার লেখা?”
“নাইন ইলেভেন কোন সালের কত তারিখে হইসে বলতো। ধুর শালা, তারিখ তো আমিই বলে দিলাম।”
“কিরে বাড়া, তোর তো দেখি কিছুই মনে পড়তেসে না। আমার তো সব শাঁই শাঁই করে মনে পড়ে যাচ্ছে। গাছটায় আসলেও কিছু আছে বুঝলি। মেমরি একদম নাইফের মত শার্প ফিল হচ্ছে। বুঝতে পারতেসি মাথার মধ্যে একটা নাড়াচাড়া।”
“তুই বাল বুঝতেছিস। যেসব জিনিস তুই আস্ক করতেছিস, এইগুলা তুই সবসময় জানতি। নতুন করে কিছুই মনে পড়ে নাই। আর ঐ প্রসাবের সরবত খেয়ে আমার মাথার মধ্যেও নাড়াচাড়া করতেসে। হারামজাদারা কি খাওয়াইসে আল্লাহ্ মালুম। মেমরি বাড়া তো কচু, স্মৃতিশক্তি হারায় এখন চেগায় পড়ে থাকলেও অবাক হব না শালা।”
এরপরও দিন দশেক রফিকের মাথায় দৃঢ়ভাবেই গেঁথে থাকলো যে ঐ নাম না জানা গাছের পাতা খেলে মানুষের স্মৃতিশক্তি লিটারেলি ইনফিনিটি লেভেলের হয়ে যায়, সে পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী জীবনের আর কিছুই ভোলে না।
আমি বিরক্ত হয়ে দুই-একটা ঝাড়ি বা সার্কাস্টিক কমেন্ট করার বেশি কিছু করলাম না। জানি রফিকের মাথার এই ভূত কয়েকদিনে চলে যাবে। নতুন আরেকটা কিছু নিয়ে হাজির হবে আবার মাসখানেক পরেই। ওর কথায় একবার প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির রাতে আমরা ট্রেনের ছাদে উঠে পড়ি। খুব ঠান্ডার মাস না, তবু বৃষ্টির ফোঁটা গুলো গায়ে পড়ার সাথে সাথে মনে হচ্ছিল কেউ আমাকে ফ্রিজের দড়জায় ঠেসে ধরেছে। সেই লেভেল আরেকটু আপ হল যখন শিলা পড়া শুরু হল। রফিক রীতিমত খুশিতে লাফাচ্ছে। আমার দিকে তাকায় চিৎকার করে উঠলো?
“তুই এমন হাগু হাগু মুখ করে আছিস কেন শালা? চারদিক দিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিসি। পড়ে মরবি না।”
“ শুয়োর! পরে মরা লাগবে না। বাজ পরে পুরা শামি কাবাব হয়ে যাব।”
কিছু কিছু জায়গায় ট্রেন বন টাইপ এলাকা দিয়ে গেল। আমি আর রফিক সমানে নিচু গাছের ডালপালা বুলেট ডজ্ দিচ্ছি। সেই যাত্রা কিভাবে বেঁচে ফিরলাম আসলেই জানি না। ঢাকায় ফিরে আমার তেমন কিছু হল না, রফিক বিরাট জ্বরে পড়লো। পুরা এক সপ্তাহ বিছানার সাথে লেপ্টে থাকলো বেচারা।
রফিকের প্যানপ্যানানিতে একটা সম্মোহনী শক্তি আছে বলে আমার বিশ্বাস। নইলে প্রতিবার নানান কসম কাটার পরও আমি কিভাবে তার নেক্সট প্রস্তাবে রাজি হই, এটা আমার কাছেই একটা রহস্য। তবে ওর সব পাগলামি যে আমার জন্য শেষ পর্যন্ত হতাশার পরিণতি হইসে, ব্যাপারটা এমনও না। একবার আমরা শাহ্জাদপুরের এক প্রত্যন্ত গোরস্থানে রাত কাটাতে গেলাম। চারপাশে শুনশান নিরবতা। মেঘের আড়ালে লুকোনো চাঁদ একটু পর পর উঁকি দিচ্ছে। সবকিছু তাতে আবছা আবছা দেখা যায়, বড় মায়াবী লাগে। ভূতের ভয় আমার কখনোই ছিল না, কিন্তু মধ্যরাতে অচেনা এক গ্রাম্য গোরস্থানে বসে আমার গায়ে অদ্ভুত কাঁটা দিতে লাগলো। হঠাত রফিক আমার হাতে হাত রাখলো। আমি এতটাই চমকে গেলাম গলা দিয়ে বিশ্রী একটা শব্দ বের হয়ে গেল, চিৎকারের বাকি অংশটা হজম করে ফেললাম। দেখলাম একটা কবরের পেছন থেকে একটা দুটো করে হাজার হাজার জোনাকি বের হয়ে আসতে। দেখতে দেখতে গোরস্থানের একটা অংশ লক্ষ লক্ষ জোনাকিতে ভরে গেল। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। ভাষায় বর্ণ্না করার পুরোটাই অপচেষ্টা আসলে। আমি আলতো চাঁদের আলোয় রফিকের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তির হাসি নিয়ে সে সামনের দিকে তাকিয় আছে।
বন্ধুমহলে আমার আরেকটা নাম আছেঃ ভর্তাখোর। কোন ফ্রেন্ডের বাড়িতে গেলে সবাই যখন গরু-মুরগির বাটির দিকে হামলে পড়ে, আমি সেখানে যেকোন ধরণের ভর্তা থাকলে সেটা দিয়ে একপ্লেট ভাত নিমেষে শেষ করে ফেলি। রফিক আমাকে একবার নিয়ে গেল বান্দরবন। বান্দরবন গেলে সবাই যে পরিচিত হাইক গুলা করে, বগালেক, কেওক্রাডং, নাফিয়াখুম, আমিয়াখুম, সে সেসবের ধার ধারলোনা। এক নাম না জানা নদী অর্ধেক নৌকায় অর্ধেক হেঁটে পার হয়ে আমরা আরো বেশ কিছুদূর হাইকিং করে পৌঁছলাম এক কুঁড়ে ঘরে। বাইরে একটা মাচাং টাইপ বসার জায়গা, পেছনে অগোছালো একটা বাগান মিশে গেছে প্রাকৃতিক জঙ্গলের সাথে; খুব দক্ষ নাপিতেরা যেভাবে চুলের লেয়ারগুলো মিলিয়ে দেই ঠিক তেমনি। ঘর থেকে এক বুড়ি বের হয়ে এসে রফিককে জড়িয়ে ধরলো। আমরা আধুনিক শহুরে ছেলেমেয়েরা কথায় কথায় বন্ধু-বান্ধবীদের হাগ দেই। কিন্তু এই জড়িয়ে ধরা “হাগ” না, এটা অন্যকিছু। মনে হল যেন বুড়ির শরীরের সমস্ত মমতা, সমস্তা ভালবাসা সে রফিকের মধ্যে কোন এক অদৃশ্য উপায়ে ট্রান্সফার করে দিল।
“চাচী আমার এই বন্ধুর কথাই তোমারে কইসিলাম। ভর্তাখোর হা হা। দেখি তোমার ভর্তাগুলা রেডি কর দেখি।”
বুড়ি একে একে মাটির পাত্রে পাঁচটা ভর্তা এনে রাখলো। সাথে এক সানকি ভাত, এক বাটি ডাল। ডালের মধ্যে ভীষণ তাজা কিছু গাছ গাছালির সব্জেটে ডানটি দেখা যাচ্ছে। ভর্তাগুলার একটাও চিনতে পারলাম না। আমি মুখ খুলতে যাব, রফিক কথা বলে উঠলো।
“দাড়া, খাওয়ার আগে দুইটা বিষয়। একটা শর্ত, একটা প্রেডিকশান বা সতর্কবার্তা।”
যেকোন কিছুতে নাটকীয় ফ্লেভার এড করা রফিকের প্রিয় অভ্যাস। আমি হেসে সাঁয় দিলাম, “বলে ফেল, শুনি।”
“শর্ত হচ্ছে কোনটা কিসের ভর্তা, ডালের মধ্যে এইটা কি দিসেন চাচী, রেসিপিটা প্লিজ বলেন এইজাতীয় কুলড্যুড টাইপ প্রশ্ন করবিনা। চুপচাপ খাবি, খাওয়াটা ফিল করবি।
আর প্রেডিকশানটা হচ্ছে তুই তোর ডেথবেডে এই বস্তু আবার খাইতে চাইবি। বিরাট ঝক্কি হবে।বান্দরবন আসা, নদী পাড় হওয়া, পাহাড়ে চড়া, কি আর করা। আমি তাও ট্রাই করবো। তবে দিন দুয়েক টাইম লাগবে,আগেই বলে রাখলাম। ততক্ষণ ঝুলে থাকিস।”
আমি ফিক করে হেসে ফেলে খাওয়া শুরু করলাম। বান্দরবনের এক ছোট্ট পাহাড়ের ছায়াঘেরা এক মাচাঙ্গে এক অচেনা বৃদ্ধার হাতপাখার বাতাসে বসে খেতে খেতে আমি বুঝলাম রফিক ঠিকই বলছে। আমি খুব সম্ভবত ডেথবেডে এই জিনিসই খেতে চাইবো। এর থেকে সুস্বাদু কোন কিছু আমি আমার চব্বিশ বছরের জীবনে খাইনি, ভবিষ্যৎ-এও খাব এমন কোন সম্ভাবনা দেখি না।
তেরোর ফেব্রুয়ারিতে আমি ধুপ করে আমেরিকায় স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। ধুপ করে বলছি কারণ পুরা প্রসেসটা আমার খুব একটা প্ল্যান্ড ছিল না। আমি নিম্ন-মধ্যম ক্যাটাগোরির ছাত্র ছিলাম আজীবন। তবে অংকটা ভাল পারতাম, আর টিউশানির অভ্যাস ছিল। একগাদা পোলাপান পাশ করেই জিয়ারি দিচ্ছে দেখে সেই ফ্লোতে আমিও তাদের সাথে হালকা প্রিপারেশান নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে দিলাম। অংকের জোরে হোক আর ইংরেজি থ্রিলার বই পড়ার অভ্যেস, জিয়ারিতে বেশ ভাল করে ফেললাম। রফিক এসবের ধার ধারলো না। সে বেশ কয়েকটা পত্রিকায় পার্টটাইম কাজ করে তখন। এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরেই ওর দিন কাটে। কখনো অদ্ভুদ সুন্দর কোন ছবি পত্রিকায় জমা দেয়, কোথাও দেয় অস্বাভাবিক কোন ঘটনা। আবার কোথাও নিজের লেখা রম্য রচনা। লেখার হাত সবসময় অসাধারণ ছিল রফিকের। কিন্তু জীবনের আর সবকিছুর মতই একটা প্যাশনে কখনো নোঙর গাড়তে পারে নি। তাই লেখালেখি করলেও সেটা ছিল ইরেগুলার। সে সবসময় বলতো সে এমন একটা জিনিস লিখতে চাই, সেটা না হবে গল্প, উপন্যাস, না কবিতা, না গান। ঐ লেখা নিজেই হবে এক নিজস্ব ক্যাটাগরির সৃষ্টি।
আমি অনেকবার ওকে প্রশ্ন করেছি, “এই যে তুই অদ্ভুত ফুলের ছবি তুলিস, অদ্ভুদ ঘটনা পত্রিকায় ছাপাস, ঐ বুড়ি চাচীর কথা বা শাহ্জাদপুরের সেই জোনাক-জ্বলা গোরস্থানের কথা কেন কখনো লিখিস না?”
জবাবে রফিক অদ্ভুত হাসি দিয়েছিল। “কিছু জিনিস শুধু মনে রেখে দিতে হয়। সেগুলা কারো সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছা করে না, শেয়ার করতে হয় না।”
“আমার সাথে যে শেয়ার করলি সেগুলা? শুধু শেয়ার না, আমাকে তো এক্সপেরিয়েন্সও করালি!”
রফিক এবার গা দুলিয়ে হেসে উঠলো।
“আরে তুই তো তুই।”
রফিকের সেই আমি তো আমি যখন তেরোর অগাস্টে আমেরিকা পাড়ি দিলাম, রফিক মনে হল না ঘটনাটা তখনো পুরোপুরি হজম করতে পারতেসে। যে ছেলেকে আজীবন মায়ার বাঁধনে বাঁধা যায় নি, সে নিজে আজ যেন প্রথমবার বাঁধন ছেড়ার কষ্ট বুঝতে পারলো।
“তুই তো মাস্টার্স শেষেই চলে আসবি রাইট? আর নেক্সট ডিসেম্বরেই তো ঘুরতে আসতেছিস!”
রফিক আর যাইহোক বোকা না। আমার ফ্যাকাসে হ্যাঁ সূচক হাসিতে সে বুঝে নিল ওর সকল পাগলামির সিকিভাগের অংশ হতে আমি আর কোনদিন আসবো না।
রফিক কখনোই খুব একটা টেক-স্যাভি ছিল না। এই যুগে এসে কোন যুবক ছেলের ফেসবুক একাউন্ট থাকবে না, এটা ভাবা যায় না। রফিকের সেটাও ছিল না। আমি আসার আগে জোর করে ওকে হোয়াট্সএপে একাউন্ট খুলে দেই। সেখানেই ওর সাথে কথা হতে থাকে। প্রথমদিকে খুব রেগুলার কন্টাক্ট হলেও পড়ে আসতে আসতে তাতে ভাটা পড়ে। আমি কোর্সওয়ার্ক থেকে শুরু করে টিএর কাজ, রিসার্চ, রান্নাবান্না সব কিছুতে হাবুডুবু খেতে থাকি, রফিকও কয়দিন পর পর চলে যায় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, পঞ্চগর, টেকনাফের নেটওয়ার্কের বাইরের কোন ঠিকানায়। চৌদ্দর ডিসেম্বরে দেশে যাবো ভেবেও যাওয়া হলো না, থিসিসের কাজ অনেক বাকি। ঠিক সময়ে গ্র্যাজুয়েশান করা হবে না দেশে গেলে, সামনে ফেব্রুয়ারিতেই আবার পেপার ডেডলাইন। রফিককে জানালাম একবারে নেক্সট বছর আসবো, জব হোক। যদিও যানতাম জব হলেই সাথে সাথে যাওয়া যাবে না, ভিসা স্ট্যাটাস চেঞ্জের বিশাল ঝামেলা আছে সামনে। ছেলেটা খুবই মন খারাপ করলো। শুধু বললো, “আচ্ছা।আমি নতুন কিছু ভর্তা বানানো শিখছি। তুই আসলে খাওয়াবো।”
শেষ পর্যন্ত আমি দেশে গেলাম সতেরোর ডিসেম্বর। রফিকের সাথে আমার শেষ কথা হয় ষোলোর অক্টোবরে। ও টেক্সট করে, “তুই তো এই ডিসেম্বরেও আসতেছিস না, রাইট?” ওর কণ্ঠে অভিমানের সুরটা স্পষ্ট টের পেলাম। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিখলাম “না”। এরপর ওর সাথে আমার আর কথা হয় নি। বেশ কয়েকবারই টেক্সট করি। কোন উত্তর পাই না। আরো কয়েকটা কমন ফ্রেন্ডদেরও টেক্সট করলাম, কেউ ওর খবর জানে না গত একবছর। আমি বিরক্ত হলেও খুব একটা অবাক হলাম না। রফিক এর আগেও ছ’ মাসের জন্য সম্পূর্ণ উধাও হয়ে থেকেছে, এটা খুব নতুন কিছু না। ঠিক করলাম দেশে যেয়ে নিজেই খুঁজে বের করবো।
দেশে থাকার জন্য এক মাসের ছুটি নিয়ে গিয়েছিলাম, তার প্রথম বিশ দিন নানা কাজের ফাঁকে নানাভাবে চেষ্টা করেও রফিকের কোন হদিস পেলাম না। রফিকের বাবা মা বহু আগে মারা গেছে। ঢাকায় ওর এক মামা আর এক ফুপুর বাসা চিনতাম, তাদের ওখানে গেলাম, তারাও কোন খোঁজ দিতে পারলো না। যে ছেলে থেকে থেকেই কিছুদিনের জন্য উধাও হয়ে যায়, তার এই খোঁজ না পাওয়াতে কেউ খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হল না। রফিকের হোয়াটসএপেও আমি কল দেই নিয়ম করে, কল যায় না।
হুট করেই একদিন ফোন আসলো হোয়াটসএপে। অচেনা এক নম্বর। গ্রাম্য এক্সেন্টে একজন জিজ্ঞেস করল?
“আফনের নাম কি রাশেদ?”
খুব কম মানুষই প্রথম চেষ্টায় আমার নাম ধরতে পারে। আর গ্রামের মানুষ হলে তো কথায় নাই। আমি মূল বিষয়ে যাওয়ার জন্য বললাম হ্যাঁ।
“রফিক বাই এই নাম্বার দিয়ে আফনেরে কল করতে কইসে।”
বলে ছেলেটা কুষ্টিয়ার একটা ঠিকানা বলল। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ঠিকানাটা লিখে নিলাম। আমার মাথার রগ দপ দপ করতে শুরু করলো। কোন মত ব্যাগ গুছিয়ে সেদিনের কাজগুলা সেরে রাতের বাসে কুষ্টিয়া রওনা হলাম।
গড়াই নদীর ধারে একটা সুন্দর ছিমছাম কুঁড়েঘর। তিনদিন ধরে আমি সেখানেই আছি। রফিক আমাকে চিনতে পেরেছে, কিন্তু অলমোস্ট আর বাকি কিছুই মনে করতে পারে নি। এই ঘরটা ওরই বানানো। আট মাস আগে এখানে এসে ঘাটি গাড়ে ও, এই ঘরটা তুলে সেখানে বসে লেখালেখি করতে থাকে। ওর সেই লেখা, যা না হবে কোন উপন্যাস, কোন কবিতা, কোন ছোটগল্প বা কোন গান। সেইটা নিজেই একটা নিজস্ব ক্যাটাগরি হবে। নদীর ধারে দুই কামরার কুড়ে ঘর, পাশেই ছাউনি দেয়া মাচাং। এখানে চা খেতে খেতে প্রতিদিন লিখতে বসতো ও। এরপরে কোন একদিন গাঁয়ের কোন এক বিয়েতে যেয়ে প্রচুর খাওয়া দাওয়া করে ও। শুনলাম সেই রাতে অসম্ভব গরম পড়েছিল। রাতের বেলা ব্রেইন-স্ট্রোক। সেই থেকে রফিক এখানেই। ওর দিন কাটে গড়াই নদীর তীরে একমনে তাকিয়ে থেকে। মাঝে মাঝে কিছু অর্থহীন কথাবার্তা বলে। আমি রফিককে এর আগে কতবার বকা দিয়েছি,
“বালের মত অর্থহীন কথা বলবি না তো।”
সেই অর্থহীন কথা আর এগুলো এক না। আমি রফিকের আগের সেই অর্থহীন কথা, অর্থহীন গল্প শোনার জন্য মুখিয়ে থাকি।
চতুর্থ দিন রাতে রফিকের অবস্থা খুব খারাপ হল। আমি তার আগের দুইদিন ধরেই রফিককে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসার ব্যাবস্থা করার প্রসেসে ছিলাম, কিন্তু তখন অবস্থা এত খারাপ হল যে এত দূরে সাথে সাথে নেয়া পসিবল হল না। আমরা ওকে কুষ্টিয়া সদরে ভর্তি করলাম। রফিক ঘুমুচ্ছে, আমি ওর মাথার পাশে একটা চেয়ারে তাকিয়ে সামনে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।
“কিরে ভর্তাখোর!”
আমি চমকে পাশে তাকালাম। রফিক ফ্যাকাসে একটা হাসি দিয়ে কোনমতে চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি খুশিতে কেঁদে ফেললাম। ও হাত বাড়িয়ে আমার হাতটা ধরলো। ধরে বললো
“তোকে করা প্রেডিকশানতো উলটা আমার জন্য সত্যি হয়ে যাচ্ছে রে। চাচীর ভর্তা খেতে ইচ্ছা হচ্ছে খুব।”
আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। সে যে ডেথবেডে আছে, রফিক নিজেও তাহলে এটা বুঝে গেছে। আমি ওকে কোন সান্ত্বনা দিতে গেলাম না। বললাম
“তাহলে বাকি প্রেডিকশানটাও মান। তোর জন্য আমি ভর্তা আনবো। দুইদিন টাইম লাগবে। তুই ঝুলে থাক।”
রফিক আপ্রাণ চেষ্টা করেও ঝুলে থাকতে পারলো না। দেড়দিন পর ফিরে এসে আমি গোরস্থানে গেলাম। সেখানে মেঘের আড়ালে চাঁদ লুকোচুরি খেলছে। হঠাৎ দেখলাম রফিকের কবরের পেছন থেকে একটা জোনাকি ভেসে উঠলো। এরপর আরেকটা। তারপর আরো কয়েকটা। নিমেষেই গোরস্থানের একটা অংশ জোনাকিতে ভরে গেল। আমি শূন্য দৃষ্টিতে জোনাকিদের স্রোতের মাঝে শুয়ে থাকা রফিকের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার হাতে নাম না জানা পাঁচ পদের ভর্তা।
Comments