top of page

আঁধারে সমাধি

ঘরটাতে আলো তেমন ঢোকে না, এই দিনের বেলায়ও অন্ধকার অন্ধকার একটা ভাব ঝুলে থাকে, অস্বস্তি মেশানো অন্ধকারের সাথে প্লাস্টার খসে যাওয়া দেয়ালে ঝোলানো বিশাল আদিম দেয়াল ঘড়িটার টিকটিক শব্দ যখন প্রকট ভাবে শোনা যায়, তখন অস্বস্তিটা একটু একটু ভয়ে বদলে যেতে সময় লাগে না।

এখন এ ঘরে তেমন এক নীরবতা বিরাজ করছে কিছুক্ষন ধরে।

অবশেষে কালো করে কোঁকড়া চুল লোকটা নীরবতা ভাঙল। ওর নাম যতীন। রুমাল দিয়ে নাক ঝাড়তে ঝাড়তে বলল-

-আচ্ছা, বিকাশকে আরেকবার মেরে ফেললে কেমন হয়?

সাদাটে লম্বা লোকটার ফ্যাকাসে মুখ থেকে বুঝি আরও কিছু রক্ত সরে গেল। এর নাম দীপক। নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল-

-মানে? তোমার কথা ঠিক বুঝলাম না! মরা কে আবার মারবে কি করে?

হাসতে গিয়ে যতীন কেশে উঠল। কাশতে কাশতেই বলল-

-বোঝ নি, না। হুম, দেখ- ওদের সন্দেহটা আমাদের উপর থেকে সরাতে হবে।

-সে জন্যই তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি। একি কথা বারবার রিপিট করছ কেন?

-সে জন্যই বিকাশকে আরেকবার মারতে হবে, বুঝলে।

চোখ সরু হয়ে এসেছে দীপকের।দাঁত কিড়মিড় করে বলল-

-তুমি কি সবকিছু দয়া করে একটু খুলে বলবে? যাকে আমার সামনে ছুরি মেরে লাত্থি দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দিলে, এখন বলছ তাকে আবার মেরে ফেলতে হবে। মানেটা কি এর?

সিগারেটটা ধরিয়ে নিল যতীন। জোরে একটা টান দিয়ে বলল-

-ঠিক আছে খুলেই বলি তাহলে। বিকাশের বাপের এক রাঢ় ছিল মনে আছে?

-হুম্ম, খুব আছে। যেমন রুপসী, তেমনি –

চোখ টিপল দীপক।

যতীন হাসল।

-সেই রাঢ়ের এক ছেলে আছে। আমাদের থেকে কিছু ছোট, বুঝলে। বিকাশের সাথে যথেষ্ট মিল আছে মালটার। একটু রং-টং মাখালেই বিকাশ বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।

ভুরু কুঁচকে গেল যতীনের।

-তাই নাকি? ওই মাগীর এক ছেলে আছে জানতাম, আর কিছু জানি না। তা তুমি ও শালাকে যোগাড় করলে কোত্থেকে, আর কেনই বা?

-ধীরে বন্ধু ধীরে।

ফাঁকা হয়ে যাওয়া ব্র্যান্ডির গেলাস দুটোতে আরেকবার ব্র্যান্ডি ঢেলে এগিয়ে দিল যতীন একটা দীপকের দিকে। আরেকটা মুখে তুলে বলল-

-বিকাশের নিখোঁজের পর পুলিশ সহ সব্বাই যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছে, তাতে আমাদের ধরা পড়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি ঐ ছোকড়ার সাথে কথা বলেছি। ওকে বিকাশ হিসেবে সমাজে হাজির করব। এক কি দু-দিন ও শালা বিকাশ হিসেবে অভিনয় করে যাবে।এতদিন কোথায় ছিল, কি করেছে এসব প্রশ্নের জবাবও সাজিয়ে দিয়েছি। ওতে দুদিন চালিয়ে নেবে। তৃতীয় দিন ওই ব্যাটা কার এক্সিডেন্টে মারা যাবে।

-কি? এ কথা জেনে ওই শালা রাজি হয়েছে?

-হুম্ম, হয়েছে। ও মালের এম্নিতেই ব্রেন ক্যান্সার। শেষ স্টেজ চলছে। ওর ফ্যামিলিকে ৫ লাখ দিচ্ছি, রাজি না হয়ে যাবে কোথায়?

-৫ লাখ!!

-দেখ,প্রসন্ন আর বিকাশের ভাগ মিলিয়ে আমরা প্রত্যেকে সাড়ে বার লাখ করে মেরেছি। নিরাপত্তার খাতিরে এখন পাঁচ-সাত লাখ খরচ করতেই হবে। নইলে এক টাকাও শেষে ভোগ করা হবে না।

-হুম্ম।

চোখ বন্ধ করে বসে রইল কিছুক্ষণ দীপক। ভাবছে।

-বেশি প্যাঁচাতে গিয়ে আবার ধরা পড়ব না তো?

-নাহ্‌, সবদিক ভেবেই কাজে নামব। তাহলেই হবে।

-মালটাকে একবার দেখা দরকার।

-হুম্ম, সে ব্যবস্থা করেছি। প্রসন্নদের বাড়ির কাছেই থাকে। বিপীণকে বলা আছে, ওখানেই আসতে বলেছি ওকে পরশু।

বিপীণ প্রসন্নর যমজ ভাই।

-ওদের ওখানে আবার কেন?

প্রসন্নকে খুন করার পর ওদিকটায় যেতে দীপকের সব সময়ই ভয় লাগে। বিকাশের খুনটা যতীন করলেও প্রসন্নকে খুন করেছে দীপক নিজে।

আবার কাশি শুরু হয়েছে যতীনের। থেমে থেমে বলল-

-ওখানেই যেতে হবে, কিছু করার নেই। তাছাড়া বিপীণতো সব জানেই। ও আমাদের সাহায্যও করেছে, নিজের ভয়েই এখন এগুলো আর প্রকাশ করবে না। বাপের সম্পত্তির ভাগ না দিতে হওয়াতেই ওই খচ্চরটা বেজায় খুশি।

-হুম, তাহলে পরশু দেখা হচ্ছে ?

চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল দীপক।

-হ্যাঁ, ঠিক সময়ে চলে এস বিপীণদের বাড়িতে।

উঠে যেতে যেতে দীপক হঠাৎ প্রশ্ন করল,

-আচ্ছা তোমার ঐ কাজের ছোকড়া, কি জানি নাম, ও হে দিলীপ, ওকে আর পেলে?

-নাহ্‌, ও শালা একেবারেই ভেগেছে মনে হয়।






প্রসন্নদের বাড়ির বেযমেন্টের গুপ্তঘরটা থেকে আলো হাতে উঠে এল বিপীণ। হাতে রক্ত লেগে ছিল, বেসিনে ধুয়ে নিল। এগোল ড্রইংরূমের দিকে।

যতীন আর বিকাশ বসে আছে সেখানে উদ্বিগ্ন মুখে।

-কখন এলেন?

হাত মুছতে মুছতে প্রশ্ন করল বিপীণ।

-এই তো, মাত্র। তোমার কাজ শেষ? মেরেছ ওকে?

-হুম, যান না, গিয়ে দেখে আসুন গে, দীপকদা এতক্ষণে স্বর্গে পৌঁছে গেছে। হয়তো, প্রসন্নদার সাথে বসে সাপলুডু খেলছে।

বলে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল বিপীণ।

-হুম ,চলো দেখেই আসি।

বিকাশকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল যতীন।

-নিচের ঘরটায় না?

-আজ্ঞে, যান। আর এই বাতিটা নিয়ে যান। ওখানে বড্ড অন্ধকার।






বিকাশ সে রাতে মারা যায় নি। কিন্তু নিখোঁজ তো হয়েছিল বটেই।

বিকাশ ছিল যতীনের সবচে প্রিয় ও পুরনো বন্ধু। দুজনের চরিত্রে যতই নীচতা ও নোংরামি থাক, ওদের বন্ধুত্বে কোন খাদ ছিল না। তাই কিডন্যাপিং থেকে পাওয়া পঞ্চাশ লক্ষ টাকার ভাগিদার কমাতে যখন যতীন বিকাশকে খুন করার প্রস্তাব দেয় দীপকের কাছে, দীপক বেশ অবাকই হয়েছিল। খানিকটা সন্দেহও যে করে নি, তাও নয়। কিন্তু যখন নিজে দেখল যে পাহাড়ের ঢালে নিয়ে বিকাশকে ছুরি মেরে যতীন লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছে, তখন আর বিশ্বাস না করেই বা উপায় কি?

ঘটনাটা ছিল সাজানো। যতীন বিকাশের হাতে ছুরি মারে, বুকে নয়। আর পাহাড়ের যে জায়গাটা থেকে বিকাশকে ফেলে দেয় তার নিচেই একটা ছোট্ট সমতল অংশ রয়েছে, পাহাড়ের কোণার কারণে দেখা যায় না। বিকাশকে ছুরি মারার সময় যতীন শরীর দিয়ে ঢেকে রেখেছিল বিকাশকে, বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়ানো নার্ভাস দীপক তখন তাগাদা দিচ্ছে যতীনকে আরো দ্রুত করার জন্য, গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে। নাটকটা তাই আর ধরতে পারে নি দীপক।

এসবের দরকার ছিল না, দীপককে সরাসরি খুন করে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু সমস্যা ছিল, প্ল্যান অনুযায়ী সমস্ত টাকাটা তখনও ছিল দীপকের কাছে। আর ও তা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে, জানা ছিল না কারোরই।

এসব না করে তখনকার মত যার যার টাকা সে সে নিয়ে দীপক ও প্রসন্নকে পরে মেরে দিলেও হত। কিন্তু তাতেও ঝুঁকি ছিল। কারণ সবার মনেই যে অপরকে মেরে দেয়ার চিন্তা আসবে, তা জানা ছিল যতীন ও বিকাশের। তাই প্রসন্নকে দীপককের দিয়ে খুন করিয়ে বিকাশকে মেরে ফেলার এ নাটকটা সাজানো হয়েছে।

এ দেশে দীপকের তেমন কেউ নেই। তাই ও নিখোঁজের পর তেমন কোন তোলপাড় হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।

প্রসন্নকে মারার ক্ষেত্রে সাহায্য করে বসে ওর আপন যমজ ভাই বিপীণ। তাকে কোন ভাগ দিতে হয় নি, পিতার রেখে যাওয়া অঢেল সম্পত্তির অর্ধেকের বদলে পুরোটা ভাগ পেয়েই সে সন্তুষ্ট। প্রসন্নদেরও এদেশে তেমন একটা আত্মীয়-পরিজন নেই।সব থাকে কলকাতা। তাই ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা জলঘাটা হয় নি।

সেই পঞ্চাশ লাখ টাকাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে বিপীণদেরই বেযমেন্টের আরেকটা গুপ্তঘরে।এমনকি দীপকের অংশও,পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে দীপকও আর দ্বিধা করেনি। পরিস্থিতি শান্ত হলে সময় সুযোগ করে যতীন ও বিকাশের তা সরিয়ে নেওয়ার কথা।

এরচে ভাল কোন উপায় ও হয়তো ছিল, কিন্তু উত্তেজনাকর সে পরিস্থিতিতে এরচে ভালো কিছু মাথায় আসে নি ওদের। তাই বিকাশ, বিপীণ আর যতীন মিলে এ নাটকের ব্যাবস্থা করেছে।







উপুড় হয়ে পড়ে আছে দীপক। গলায় ছুরির পোচ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আশেপাশের জায়গা রক্তে ভিজে গেছে।

সন্তুষ্ট চিত্তে হাসল দুজন। বিকাশ আর যতীন।

-চল, কুপির আলো নিভে আসছে।তাড়াতাড়ি বের হওয়া দরকার।

-হুম, চল।

মই দিয়ে উঠে বের হওয়ার ঢাকনিটা খুলতে গিয়েই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল বিকাশের, বাইরে থেকে লাগানো। কিছুতেই খুলছে না। যতীন কোনমতে বিকাশকে ক্রস করে এসে দুজন মিলে একসাথে ঠেলে খোলার চেষ্ট করল, পাথর আর লোহার মিশ্রণে তৈরি ঢাকনিটা তাতে একচুল ও নড়ল না।

ততক্ষণে কুপি নিভে গেছে।

বিকাশ আর যতীনও বুঝে গেছে, কোন চেষ্টাতেই কিছু হবে না। সবকিছু ভেবেই বিপীণ কাজটা করেছে। খাওয়ার আর পানি ছাড়া এই ঘুটঘুটে আঁধার ঘরে ওরা খুব বেশি হলে সাতদিন বাঁচবে, তাও যদি লাশপচা গন্ধ সয়ে থাকতে পারে। ওরা হাজার চিৎকার চ্যাঁচামেচি করলেও বাইরে এর টুঁ শব্দটি যাবে না। বেরোনোর পথ সম্ভবত নেই, থাকলেও ঘুটঘুটে আঁধারে তা বের করা অসম্ভব। কিচ্ছু করার নেই, মৃত্যুর অপেক্ষা ছাড়া। এরচে আত্মহত্যা করা বোধহয় অনেক ভাল।

কোনমতে আঁধারে হাতড়ে হাতড়ে দীপকের পাশ থেকে ছুরিটা তুলে নিল যতীন। তারপর অন্ধকারেই আত্মহত্যার পূর্বে জীবনের শেষ খুনটি করল। ও জানে, ওর প্রিয় বন্ধুটির নিজেকে হত্যা করার মত সাহস নেই।






বিপীণ সিঁড়ির মুখটার কাছে কান পেতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল । না, কোন শব্দ আসছে না। জানে, আসবে না। তাও নিশ্চিত হওয়া।

ধীরে ধীরে হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল ওর সমস্ত মুখে।

পঞ্চাশ লাখ টাকার ভাগ চাইতে এখন আর কেউ আসবে না। ওকেও আর কেউ কোনদিন প্রসন্ন বলে চিনতে পারবে না। জানবে না, সেরাতে দীপকের ওখানে প্রসন্ন যায় নি, গিয়েছিল বিপীণ। প্রসন্নই ওকে পাঠিয়েছিল উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে শুনিয়ে। যতীনের কাজের ছেলে দিলীপকে টাকা খাইয়েছিল প্রসন্ন আগেই, লুকিয়ে যতীন ও দীপকের প্ল্যান শোনার জন্য। তারপর সব শুনে নিজেই বিপীণ সেজে বিকাশ ও যতীনের সাথে আলোচনা করে বাকি সব কিছু জেনে নেয়। এরপর কোন সাক্ষী না রাখার জন্য টাকা দেবার নাম করে ডেকে এনে খুন করে দিলীপকে। তারপরের ঘটনাটুকু তো আর পাঠকের অজানা নয়।

বিপীণকে খুন করার পেছনে টাকার চাইতেও আরও বড় একটা কারণ ছিল প্রসন্নের কাছে। সেটি হল বিপীণের স্ত্রী আমরিতা। বিয়ে হওয়ার সাত দিনের মাথায় মারা যায় বিপীণ। অপূর্ব সুন্দরী আমরিতা তখনও নববিবাহিতা স্বামীকে তার যমজ ভাই থেকে সনাক্ত করার মত করে চিনে উঠতে পারে নি। সুযোগটা কাজে লাগায় প্রসন্ন। এদেশে তার আত্মীয়-স্বজন তেমনটি না থাকায় দিব্যি নিজেকে বিপীণ সাজিয়ে আমরিতার ভালবাসা দখল করে নিয়েছে সে অদ্ভুত কৌশলে।



ঘরে ঢুকল প্রসন্ন ওরফে বিপীণ। আমরিতা তখন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। গোলাপী শাড়িতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ওকে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে প্রসন্ন।

রেডিওতে বেজে চলেছে ওর প্রিয় গান-

“আমি কাঁটাতারেই সুখী

এই কুয়াশাতে উঁকি দিয়ে, রাজি মিথ্যে নিতে-

আসলে সত্যি বলে, সত্যি কিছু নেই।”


Recent Posts

See All
ভর্তাবিলাস

“এই বাল দেখানোর জন্য তুই আমাকে সাত কিলোমিটার হাঁটাইলি?” কথাটা মনে হয় না রফিকের কানে ঢুকলো। সে এমনভাবে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে ও...

 
 
 
বাগানবিলাস

১ এমন অদ্ভুত রঙের গোলাপ জাহিদ কখনো দেখে নি। ফুলের দোকানের সামনে প্রচুর ভীড় দেখে সে কৌতুহলে থেমেছিল, এবার কারণটা বুঝতে পারল। কালো-হলদু...

 
 
 
গতিসীমা পঁয়ত্রিশ

“স্যার, আপনার সাথে একটু আলাপ ছিল।” ইমন অবাক হয়ে তাকাল সামনের লোকটার দিকে। বয়স ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে কিছু একটা...

 
 
 

Comments

Couldn’t Load Comments
It looks like there was a technical problem. Try reconnecting or refreshing the page.
bottom of page