top of page

কূপমণ্ডূক

দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফিরে এসে ঘুমিয়েছিল রাশেদ, মিনিট ত্রিশেক যেতেই বিকট এক দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠলো সে। স্বপ্নেও সে শুয়েছিল তার এই ঘরেই, এইসময় তার কানের কাছে কে জানি এসে ফিসফিস করে বলল “রাত ১২টা ৪ মিনিটে তুই মরবি। সাবধান হইয়া যা।”


খাটের পাশের টেবিলে রাখা জগ থেকে পুরো দুই গ্লাস পানি শেষ করল রাশেদ। গলা একদম শুকিয়ে কাঠ। দুঃস্বপ্ন দেখা ওর পুরোনো রোগ, প্রায়ই দেখে। এই সপ্তাহ দুয়েক আগেও দেখেছে সে এক আমগাছের মগডালে ন্যাংটা হয়ে বসে আছে। তার স্কুলসুদ্ধ বন্ধুরা নিচে থেকে হাসতে হাসতে তার দিকে ঢিল ছুড়ে মারছে। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখা তার জন্য নতুন কিছু নয়। তবু আজকের স্বপ্নটা কেন জানি একটু অন্যরকম। বিশেষত অন্য স্বপ্ন গুলোতে বেশিরভাগ সময়ই চেনামুখ থাকে। আজকের স্বপ্নে যতদূর মনে পড়ে কোন মুখই ছিল না , ছিল কেবল একটা কণ্ঠ। সেটাও পুরুষ না নারী কণ্ঠ রাশেদ কিছুতেই মনে করতে পারলো না।


রাশেদ সারাদিন বাকি কোন কাজে মন বসাতে পারলো না। হোমওয়ার্কের প্যারাগ্রাফ লেখার সময় একগাদা বানান ভুল হল। তার অত্যন্ত প্রিয় ডিম দিয়ে ঝিঙ্গা ভাজি, আলু ভাজি আর ইলিশ মাছেও স্বাদ পেল না একটুও। ঘুরে ফিরে তার বার বার মনে হতে লাগলো তার পূর্বে দেখা সমস্ত স্বপ্নের কথা যার দুই-একটা সত্যি হয়েছে। একবার সে দেখল ইলিয়াস চাচা এসেছে, হাতে নানান ধরণের একগাদা মিষ্টি। সে রাতে সত্যি ইলিয়াস চাচা এসে হাজির, হাতে যদিও মিষ্টি ছিল না। শহর থেকে মফস্বলে আসার সময় কেউ তেমন মিষ্টি আনে না বরং যাওয়ার সময় নিয়ে যায়। ইলিয়াস চাচা সবার জন্য সুন্দর কিছু জামা-কাপড় এবং ওদের ছোটদের জন্য খেলনা এনেছিলেন। এমন তো নয় স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না। মাঝে মাঝে তো হয়! তাহলে কি আজকেই তার শেষদিন এই পৃথিবীতে?


রাত বাড়তে বাড়তে রাশেদের ভয় বাড়তে থাকলো। রাত সাড়ে দশটার দিকে সে শুয়ে পড়লো, মৃত্যু যদি হয়ই ঘুমের ভেতর হোক। কিন্তু সে অনেক্ষণ চেষ্টা করেও দু’চোখের পাতা এক করতে পারলো না। রাশেদের দাদু প্রতিদিন রাতে ঘুমের ওষুধ খান, রাশেদ চুপিচুপি ডাইনিং রুমে যেয়ে ওষুধের বাক্স থেকে একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিল। দশ মিনিট যেতেই ঘুমিয়ে গেল সে, একদম এক ঘুমে রাত পার করল। সকালে উঠে তার মন বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল, সে হুদাই ভয় পাচ্ছিল। স্বপ্ন তো স্বপ্নই। ধুর।


সেই দুঃস্বপ্ন দেখার পর পাঁচদিন কেটে গেল চোখের নিমেষে দেখতে দেখতে। রাশেদ যখন পুরো ব্যাপারটার অস্বস্তি থেকে প্রায় বের হয়ে এসেছে, সেই দিন রাতেই সে একই স্বপ্ন আবার দেখল। আবারো তার ঘরেই সে শুয়ে আছে, কানের কাছে ফিসফিস করে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো, “রাত ১২টা ৪ মিনিটে তুই মরবি। সাবধান থাকিস।” এবারের স্বপ্ন শেষ হবার আগে রাশেদ সাথে সাথে স্বপ্নের ভেতরেই পাশে খুলে রাখা হাত ঘড়িতে টাইম দেখলো। রাত ১২টা বেজে ৪ মিনিট, মঙ্গলবার। সাথে সাথেই আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল।


রাশেদের সেদিন সারারাত আর ঘুম হল না। আগেরবারের স্বপ্নের কথা ও এ পর্যন্ত কাউকে বলে নি, তবে এবার পরদিন স্কুলে গিয়ে দু’টো স্বপ্নের কথাই সে বেশ কিছু বন্ধুকে বলল। কয়েকজন একটু অবাক হল ও দুইদিন একই স্বপ্ন দেখাতে, বিশেষ করে যেখানে সময়ের এমন এক্স্যাক্ট একটা উল্লেখ আছে। কয়েকজন তেমন পাত্তা দিল না। রফিক বলল, আরে ধুর, আমি তো প্রায়ই স্বপ্নে দেখি আমি এই মেয়ে ঐ নায়িকার সাথে একই কাজ করতেসি। এগুলার কিছুই বাস্তব নাকি? তুই হুদাই প্যারা নিস না।


কিন্তু রাশেদ ভালই প্যারা নিল। আগামী দু’দিন তার কোন কাজেই মন বসলো না। রাতেও চমকে ঘুম ভেঙ্গে যেতে লাগলো কোন স্বপ্ন দেখা ছাড়াই। রাশেদের স্বপ্নের কথাও এ-কান ও কান হয়ে পুরো স্কুলের অনেকজন জেনে গেল। পরদিন টিফিনে রাশেদ চুপচাপ গম্ভীর হয়ে মাঠের ছায়াময় এক কোণে বসে ভাবছে। হুট করে পেছন থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, কি বার?

*******


রাশেদ রীতিমত চমকে উঠল। পিছে তাকিয়ে দেখে ইরা। ভাল ছেলেমেয়েদের জন্য ইরাকে বলা যায় রীতিমত রেড ফ্ল্যাগ। পড়ালেখার কোন বালাই নেই, মুখে সবসময় গালিগালাজ লেগেই আছে। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়, আজেবাজে ছেলেপুলেদের সাথে মেশে। রাশেদ সহ টিপিক্যাল “ভাল” ছেলেমেয়েরা ইরাকে বেশ ভালমতই এড়িয়ে চলে।


-রবিবার।

-আরে ধুর বাল, আজকের বার জিজ্ঞেস করিনি।


একটা ময়লা কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে রাশেদের পাশে বসে পড়ল ইরা।

-তুই স্বপ্নে কি বার দেখছিস?

রাশেদের চোখ সরু হয়ে এল। স্বপ্নে বারের ব্যাপারটা তার মাথাতেই ছিল না। কাউকে সেটা উল্লেখ করেছে বলেও মনে পড়ে না।


-তুই জানলি কিভাবে আমি স্বপ্নে কোন একটা বার দেখসি।

-কারণ এই স্বপ্ন আমিও দেখি। নাইলে এটা মেক সেইন্স করে না।

-তুইও দেখিস মানে?

-আরে ধুর বাড়া। আগে বল তুই কি বার দেখছিস।

-মঙ্গলবার। তুই বল কি মেক সেইন্স করে না? আমার কাছে তো পুরা ব্যাপারের কিছুই মেক সেইন্স করতেসে না।

-মানে ১২টা ৪ মিনিট তো প্রতিদিত রাতেই একবার আসে। তোকে এই বাল বলে কি লাভ? তুই ধুপ করে একদিন মরে যাবি, সতর্ক থাকতে বলসে। থাকবি টা কেমনে?

-কিন্তু এখনই বা সতর্ক থাকব কিভাবে? মঙ্গলবার তো আর জীবনে একটা না, বছরেই বায়ান্নটা। আমি ঐ স্বপ্ন দেখার পরও অলরেডি একটা মঙ্গলবার চলে গেছে।

-হ্যাঁ, কোন মঙ্গলবার ১২টা ৪ মিনিটে খেলাটা হবে তুই জানবি না, তাই প্রতি মঙ্গলবারই ঐ সময় তোর সতর্ক থাকা লাগবো।

-আরে ধুর সতর্কটা থাকবো কিভাবে? মরার থেকে কিভাবে সতর্ক থাকে কেউ?

-একটা উপায় আছে। তুই কালকে দুপুর ৩.৩০ এ পুরান স্কুলের পিছের যে কুয়াটা ঐখানে চলে আসিস।

-হোয়াট, ঐখানে কি? ঐ জায়গায় কেন যাবি তুই? আমার ভয় লাগে ধুর, আমি ঐখানে যাব না।

- না গেলে মর তুই কোন এক মঙ্গলবারে। আমার কি?


বলে উঠে দাঁড়াল ইরা। হনহন করে হাঁটা ধরলো।

-থাম! ইরা! অন্তত বল ঐ কুয়ার কাছে কি?

-তুই কাল আসলে তখন বলব।


রাশেদ সেদিন আরো বেশি চিন্তায় পড়ে গেল। পুরান স্কুলের কুয়া এলাকার সবাই এড়িয়ে চলে। গতবছর নভেম্বর মাসে হঠাৎ একদিন ওদের এক ক্লাস উপরের ছাত্র রঞ্জু হারিয়ে যায়। ইরা উড়নচণ্ডী বলে উপরের ক্লাসের অনেকের সাথেই তার সখ্যতা রয়েছে। রঞ্জুর সাথেও ওর বেশ ভাল বন্ধুত্ব ছিল। হারিয়ে যাওয়ার দুইদিন পর রঞ্জুর অর্ধপচা লাশ মেলে সেই পুরান কুয়ার ভেতরে। কুয়াটাতে পানি নেই এখন আর, সুতরাং ডুবে মৃত্যু হয় নি রঞ্জুর। আসলে কিভাবে মৃত্যু হয়েছে তা কখনোই জানা যায় নি। ওর সারা গায়ে কোন আঘাতের চিহ্ন ছিল না। শুধু লাশটা পাওয়া যাওয়ার সময় পর্যন্ত চোখ দু’টো অবাক বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে ছিল। সেই থেকে ঐ কুয়ার ধারেকাছে আর কেউ যায় না। কিন্তু ওকে কেন সেই কুয়ার কাছে কাল দেখা করতে বলল ইরা? সারারাত ভেবেও রাশেদ এর কোন কুলকিনারা পেল না।



*******


পরদিন দুপুরে একরাশ ভয় নিয়ে কুয়ার কাছে গেল রাশেদ। জায়গাটা এত নির্জন যে গাছের পাতা মাড়িয়ে যাওয়ার শব্দও ভারী হয়ে কানে বাজে। যেয়ে দেখল ইরা আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছে কুয়ার ধারে। রাশেদকে দেখে হাসল। ওর হাতে একটা স্যান্ডটাইমার। আরেক হাতে ঘড়ি পরে আছে, একটু পরপর সেটা দেখছে।


-এবার বল এখানে ডেকেছিস কেন।

-কাল বললাম না তুই যেই স্বপ্ন দেখিস, ঐটা আমিও দেখি। আমি দেখি যে আমি দুপুর ৩টা ৩৬ মিনিটে মরে যাব। সোমবার।


রাশেদ একবার চট করে ঘড়ি দেখে নিল। ৩ টা ৩৩!


-আচ্ছা, কিন্তু এই কুয়ার কাছে কি?

-রঞ্জুর কথা মনে আছে?

-আছে বলেই তো এখানে আসতে ভয় পাচ্ছিলাম।

-রঞ্জুও ঐ স্বপ্ন দেখতো।

-শিট! তোকে কে বললো?

-রঞ্জুই বলসে বাল! আর কে বলবে?

-ও কি ঐ সময়েই মরে শেষ পর্যন্ত?

- তা একদম ঠিকঠাক জানার তো উপায় আর নেই, লাশই পাওয়া গেল দুইদিন পরে। কিন্তু ওর স্বপ্নের বারটা ছিল বুধবার, এটা মনে আছে। আর বুধবারেই ও হারিয়ে যায়।

-এই কুয়ায় নেমেছিল কি করতে?


ইরা ঘড়ি দেখে নিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল, জলদি কুয়াতে নাম। বাকিটা ভেতরে গিয়ে বলতেসি। বলেই সে কুয়ার জং ধরা লোহার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল। একবার ইতস্তত করে রাশেদও ইরার পিছু পিছু কুয়ায় নামলো। এতদূর যখন এসেই পড়েছে, এখন আর ব্যাকঅফ করে কি লাভ!


কুয়ায় ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ইরা পকেট থেকে একটা টর্চ বের করে জ্বালিয়ে দিল, এর সাথে সাথেই বালুঘড়ি উলটে দিল। কুয়ার খাঁজে লুকোনো একটা চক বের করে মাটিতে ১ লিখলো।


-কি হচ্ছে আমাকে বলবি দয়া করে?

-এই কুয়াটার ভিতরে সময় স্থির হয়ে যায়। ব্যাপারটা কেমনে হয় আমার কোনই আইডিয়া নাই, কিন্তু হয়।

- কি আবোল তাবোল বকতেছিস? সময় স্থির হয়ে যায় মানে কি? সময়ের কোনই চেঞ্জ হয় না?

-ঠিক স্থির না, ভয়ংকর স্লো হয়ে যায়। এইখানে এক ঘণ্টা কাটাইলে বাইরে হয় গিয়ে হচ্ছে এক মিনিট।

রাশেদের মনে হল ইরা পাগল হয়ে গেছে অথবা ওর সাথে মজা নিচ্ছে। কিন্তু সে বালুঘড়িটা প্রতি মিনিটে উলটে যাচ্ছে এবং চক দিয়ে নাম্বার লিখে যাচ্ছে মেঝেতে। এত এলাবরেট জোক এমনকি ইরার জন্যও বেশি হয়ে যায়।

-তুই এতকিছু জানলি কিভাবে? রঞ্জু বলেছে?

-নাহ্‌। আমি যেদিন প্রথম ঐ স্বপ্নটা দেখি বড্ড ভয় পেয়ে যাই বুঝলি। রঞ্জুর কথা সাথে সাথে মনে পড়ে, ঔ একি স্বপ্ন দেখত। পরে অনেকভেবে মনে হয় সব রহস্য এই কুয়াতে লুকোনো আছে। কুয়াতে নেমে তন্ন তন্ন করে খুঁজি, কিন্তু বালটাও পায় নি। তবদাটা লাগে কুয়া থেকে বের হওয়ার পর। আমি সেদিন কুয়াতে কমপক্ষে ১৫ মিনিট ছিলাম। উপরে উঠে ঘড়িতে দেখি এক মিনিটও হয় নি।

রাশেদ অবাক বিস্ময়ে জানতে চায়, তারপর?

-তারপর আরো অনেকবার কুয়াতে নামি পুরা জিনিসটা ফিগার আউট করার জন্য। অনেক হিসাব নিকাশ করতে হইসে এটা বুঝতে যে কুয়াতে এক ঘণ্টা মানে বাইরে এক মিনিট।

-তারমানে তুই কুয়াতে একঘণ্টা কাটায় যখন বের হস তখন বাইরে ৩টা ৩৭? আর এভাবেই তুই বুলেট ডজ দিচ্ছিস?

-ঠিক তাই।

-কিন্তু কুয়ার মধ্যে তুই যে মরবি না এটা কিভাবে বুঝলি?

-কারণ এখানে তখন ৩টা ৩৬ বাজে না। কয়টা বাজে তাও জানি না। শুধু জানি এই কুয়াতে সময় পুরা অন্য হিসাবে চলে। এখানে ঘড়ির টাইমও পুরা এলোমেলো হয়ে যায় মাঝে মধ্যেই। এজন্যই দেখতেছিস না স্যান্ডটাইমার নিয়ে বসে আছি।


রাশেদ চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁত দিয়ে নখ কামড়ালো। ইরা স্যান্ডটাইমার উল্টাচ্ছে আর চক দিয়ে লিখছে মেঝেতে চুপচাপ।

-তাহলে রঞ্জু কিভাবে মারা গেল?

-এই নিয়ে আমার দুইটা হাইপোথিসিস আছে। আমি শিউর না কোন্‌টা ঠিক। একটা হচ্ছে এই কুয়ায় আমাদের বাইরের হিসাবে এক ঘণ্টার বেশি থাকা যায় না। থাকলে তুই মরবি।

-এটা কি ধরণের ফালতু কথা! কিভাবে বুঝলি তুই এটা?

-আমি রঞ্জু কিভাবে মারা যায় সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতেসিলাম না। পড়ে এই টাইম লিমিটের ব্যাপারটা মাথায় আসতে একটা ইঁদুর ধরে এনে এখানে ছেড়ে দেই। দেড় ঘন্টা পর কুয়ায় ঢুকে দেখি ইঁদুরটা মরে গেছে। এরপর আরেকদিন আরেকটা মুরগি ধরে এনে ফেলে দেই। সেইম। সোয়া এক ঘন্টা পর যেয়ে দেখি মরে পরে আছে। এরা অন্য কোন কারণেও মরতে পারে কিন্তু দুইটা প্রাণীরই জাস্ট এক দেড় ঘণ্টায় মরে যাওয়াটা খুব উইয়ার্ড না?


রাশেদ কি বলবে ভেবে পেল না। ইরা যা কিছু বলছে তার সব রূপকথা বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ওর নিজের সাথেই যা হচ্ছে তাতে কোনভাবেই সেগুলা অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না।


-তার মানে বলতে চাচ্ছিস রঞ্জুও এখানে এক ঘণ্টার বেশি কোন একদিন ছিল দেখে মারা গেছে?

-হ্যাঁ, হয়তো ও ব্যাপারটা বোঝেই নি। অথবা হয়তো সে জানতো কিন্তু কোনভাবে সময়ের গণ্ডগোল করে এক ঘণ্টার বেশি থেকে ফেলেছে।

-আরেকটা হাইপোথিসিস কি?

-সেটা হচ্ছে রঞ্জু জানতো এখানে এক ঘণ্টার বেশি থাকা যায় না। তাই প্রতিবার এক মিনিট মত আগে কুয়া থেকে বের হয়ে যেত। যেমন আমি যখন প্রতিদিন বাইরে বের হই, তখন কিন্তু সময় ৩টা ৩৬ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড। চান্স খুবই কম হলেও ঐ এক সেকেন্ডে আমার মৃত্যু হলেও হতে পারে। রঞ্জুরও হইতো তাই হয়েছে।


কুয়ার ভেতরে ৫৯ বার মিনিট বালুঘড়ি উল্টানোর পর ওরা দু’জন বেরিয়ে এল। ইরা ফ্যাকাসে হেসে বলল, এই সপ্তাহ বেঁচে গেলাম। কাল তোর পালা।

-তোর তো তাও ভাল দুপুর বেলা। আমার তো মধ্যরাতে বাসা থেকে কোনমতে লুকিয়ে এসে কুয়াতে নামতে হবে। এত্তসব ঝামেলা করার থেকে তো মরে যাওয়াও ভাল মনে হচ্ছে!

-আরে ধুর, কি বালছাল বলিস এগুলা। আচ্ছা যা, আমি আসবো তোর সাথে কাল।


রাশেদ ভদ্রতা করে ইরাকে মানা করতে যেয়েও শেষে করলো না। তার আসলেই মধ্যরাতে এই গহীন কুয়ায় একা ডুব দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।



*******



এরপর বিশ বছর পেরিয়ে গেছে। রাশেদ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক দুই পরীক্ষাতেই খুব ভাল রেজাল্ট করলেও এই মফস্বল শহর ছাড়ে নি। সবাই মোটামুটি নিশ্চিত ছিল সে বুয়েট বা ঢাকা ইউনিভার্সিটি কোন একটাতে চান্স পাবেই, কিন্তু সে এগুলোর কোনটাতেই পরীক্ষা না দিয়ে বাসার হাজার আপত্তি সত্ত্বেও এখানকারই এক কলেজে অনার্স করে সেখানকারই শিক্ষক হিসেবে জয়েন করে ফেলে। ওর এই ছোট্ট শহরে একেবারে শিকড় গজিয়ে বসা, হুট করে ইরার মত সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী একটা মেয়ের সাথে প্রেম, বিয়ে এর কোন কিছু্রই বন্ধু-আত্মীয়স্বজন কেউ হিসাব মেলাতে পারে নি। দু’জন মিলে এত জায়গা থাকতে কেন ঐ পরিত্যাক্ত স্কুলঘরের জমি কিনে নিয়ে বাড়ি করেছে সেটাও কারো মাথায় ঢোকে না। শুধু রাশেদ আর ইরা একই খাটে শুয়ে এখনো মাঝে মাঝে সেই একই স্বপ্ন দেখে। আর প্রতি সোম আর মঙ্গলবার যথাক্রমে দুপুর ৩.৩৬ আর রাত ১২.০৪ মিনিটে একসাথে বাড়ির বেযমেন্ট ধরে সেই কুয়ায় নেমে যায়। তারপর একহাতে বালুঘড়ি আর এক হাতে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাটিয়ে দেয় পৃথিবীর বুকে দীর্ঘতম এক মিনিট।


*******










Recent Posts

See All
ভর্তাবিলাস

“এই বাল দেখানোর জন্য তুই আমাকে সাত কিলোমিটার হাঁটাইলি?” কথাটা মনে হয় না রফিকের কানে ঢুকলো। সে এমনভাবে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে ও...

 
 
 
বাগানবিলাস

১ এমন অদ্ভুত রঙের গোলাপ জাহিদ কখনো দেখে নি। ফুলের দোকানের সামনে প্রচুর ভীড় দেখে সে কৌতুহলে থেমেছিল, এবার কারণটা বুঝতে পারল। কালো-হলদু...

 
 
 
গতিসীমা পঁয়ত্রিশ

“স্যার, আপনার সাথে একটু আলাপ ছিল।” ইমন অবাক হয়ে তাকাল সামনের লোকটার দিকে। বয়স ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে কিছু একটা...

 
 
 

Comments


bottom of page