top of page

কাব্যের ভূত

নিধিরাম সরকার কবিতার খাতাটি খুলে অনেকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। স্পষ্ট মনে আছে কাল রাতে অসমাপ্ত এ কবিতার চার লাইন লিখে তিনি ঘুমুতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে লাইনসংখ্যা কিভাবে কিভাবে জানি ছয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মানে কি এই যে, তিনি ঘুমের মধ্যে কোন এক সময় উঠে এসে বাকি দু’লাইন লিখে রেখেছেন??

এ কাজটি যে তিনি একেবারেই করেন না তা ঠিক নয়। মাঝেসাজে এমন হয়। এক একটি লেখা খুব যেন মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।কিছুতেই মাথা থেকে নামাতে পারেন না, আবার খাতাতেও নামাতে পারেন না। অগত্যা পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমুতে যান। ঘুমের মধ্যে কোন এক সময় বোধকরি স্বপ্নদেবী এসে তাকে বাকিটুকু বলে যায়। তিনিও ঘুম থেকে উঠে ঝটপট লিখতে বসে যান। তখন লেখা তরতর করে এগুতে থাকে। কিন্তু এ সবই সর্বদা সচেতনভাবে ঘটে এসেছে এতকাল ধরে।তিনি ঘুম থেকে উঠে দিব্যি সেই লেখাগুলো স্মরণে এনেছেন।কিন্তু আজই প্রথম, লেখা স্মরণতো দূরের কথা, লিখেছিলেন যে- এ কথাই মনে করতে পারছেন না।

এ লেখা তার নয় এরূপ ভাবার আরেকটি কারণ আছে। জীবনে তিনি এমন উদ্ভট লাইন লিখেছেন বলে মনে পড়ে না। তিনি গভীর মনোযোগ ও উৎকণ্ঠায় আবারও লেখাগুলির দিকে দৃষ্টি দিলেন।

“গিরিখাতও একদিন পর্বতে চড়বে

জলাশয় কিঞ্চিৎ জল হলে ভরবে

পদ্মের বুকেতেও জলপোকা উঠবে

স্বপ্নতে শুরু সব, স্বপনেতে টুটবে।”

ঠিক এরপরেই লেখা-

জিলাপিতে মিষ্টিটা কম হলে বুঝবে

জলপোকা জল ছেড়ে পায়খানা খুজবে।

কি এসব?? খুঁজবে বানানটাও ভুল!

তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর প্রচণ্ড রাগে হিজিবিজি করে কেটে দিলেন কবিতাটা। তিনি কি পাগল হয়ে যাচ্ছেন ? নইলে এগুলো কি??

শ্মশানের দিকে বিকেলবেলা হেঁটে আসা তার অভ্যাস। খারাপ লাগে না। ওদিকটা বরাবরই নির্জন থাকে। লোকজন খুব একটা যায় না। আজকাল মৃত্যুহারও কমে গেছে বেশ। তাই দাহনের কাজেও লোকের ভীড় অনেক কম। ওখানে অশ্বথ গাছটির ছায়ায় বসে কবিতা ভাবতে তার বড় ভাল লাগে।ভাবনাটাও বেশ দ্রুত আগায়। সাবলীলভাবেই।

আজও নিধিরাম সরকার গাছটির ছায়ায় বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগেই মনে হয় এখানে একটি মড়াদাহ হয়েছে। বাতাসে একটু একটু পোড়া গন্ধ। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। খারাপ লাগছে না। গন্ধটা একটু নাকে লাগছে, এই যা।

নিধিরাম সরকার চোখমুদে কবিতা ভাবতে বসলেন।

“প্রস্তরে গড়া সব অগুণিত মূর্তি

পরিধান করে ভুলে জীবনের উর্দি,

কাঁচেপেটা হৃদয়ের আঁচে লাগে সর্দি

সংগীত পরিহার, কাব্যেতে জোর দি।

খুনোখুনি-হানাহানি সোচ্চারে অস্ত্র

প্রস্তর মূর্তিতে জীবনের বস্ত্র।”

এরপরেই হঠাৎ কোত্থেকে তার মাথায় এল-

বস্ত্রটা খুলে ফেল্‌, তাহলেই চুকে যায়

পথ দিয়ে যেতে তোর, পাদখানি শুঁকে যায়।

নিধিরাম সরকার পুরোপুরি হতভম্ব। এরকম তার জীবনে কোনদিন হয় নি। তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। পাগল ছাড়া এইসব কারো মাথায় আসা সম্ভব নয়।

না! না! না!

তার পাগল হলে চলবে না। এখনও অনেককিছু লেখা বাকি। অনেককিছু। এখনই পাগল হলে চলবে কেন??

তিনি কোনমতে লাইনগুলো ঝেড়ে ফেলে সম্পূর্ণ অন্য কবিতা ভাবতে শুরু করলেন।

“নিবিড় কালো অচল আঁখি অশ্রু-সরোবরে

ভীষণ গোপন মনের বাঁধন, অসংকোচের ঝড়ে!

অরণ্যেতে পথ হারিয়ে, আবার খুঁজে বনে

রাজ্য নতুন, রাজা একই, হৃদয়-সিংহাসনে!”

এরপর আবারও হুট করে উদয় হল-

প্রজারা সব তাকিয়ে দেখে, বাইজী রাণীর নৃত্য

ডুগডুগিতে তাল দিতেছে, লেংটা রাজার ভৃত্য।

নিধিরাম সরকার আর সহ্য করতে পারলেন না।প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠলেন। সেই চিৎকার খান খান করে দিল শ্মশানের নির্জনতাকে। ভাগ্য ভাল, আশেপাশে কেউ ছিলেন না। নইলে নির্ঘাত তাকে পাগল ভাবতেন। নিধিরাম সরকার দ্রুত উঠে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলেন।এরপর প্রায় দৌড়ে চললেন। তার মনে হতে লাগল, শ্মশানের কোন ভূত যেন তার কবিতার উপর ভর করেছে।

সেদিন রাতে।

নিধিরাম সরকারের মনে হচ্ছে, ছন্দ কবিতা লেখার ফলে এরকম বোধহয় বেশি করে হচ্ছে। তারচেয়ে কিছুক্ষণ নাহয় গদ্য কবিতা লেখা যাক। তাহলে হয়তো এধরণের আজেবাজে কথা আর মনে আসবে না।

কুপির আলোটাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে নিধিরাম সরকার লেখতে বসলেন।

“সুবিশাল কোন বটবৃক্ষকে অসত্য প্রশ্ন করে

নির্দ্বিধায়, অপলকে-

প্রাচীনতায় কে এগিয়ে? আমি না তুমি?

‘অতিকায় হস্তীলোপ পেয়েছে, কিন্ত তেলাপোকা টিকিয়া আছে’

শরৎচন্দ্রের এ উক্তি বৃক্ষের জানা ছিল না।

তাই পরাজিত হাসিকে দ্বিধার সাথে মিশিয়ে সৃষ্টি করে আরেক অসত্যকে

আর দুলে দুলে হাসে!

প্রতিটি শেকড়ে, প্রতিটি শাখায় ভর করে থাকা অসত্যের হিংস্র দাপটে

ভারবাহী অশ্বও গর্ধভে পরিণত হয়;

বটবৃক্ষ- সেতো কোন ছাড়।

দিগন্তে সত্যের বলিরেখা অস্পষ্ট হতে হতে মিলিয়ে যায়

লজ্জায়, হীনতায়, দীনতায়!

অসত্য ভাইরাসে সত্যের দেহ

আজ তাই-

অতিশয় ক্ষীণকায়।”

নিধিরাম সরকার এক প্রশান্তির হাসি হাসলেন। যাক, অবশেষে ভূতটা গেছে মাথা থেকে। কবিতাটা খারাপ হচ্ছে না। লেখাও এগুচ্ছে বেশ। তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তারপর আবার তুলে নিলেন কলমখানা, তার হাতে।

ঝটপট আরও ক’লাইন লিখে ফেললেন। ঠিক তখন আবার তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। এটা কি লিখলেন তিনি? এটা কি লিখলেন??

টিকা দেয়া হয়েছিল না

বোধকরি তাই

সত্যের হইয়াছে পোলিও;

অসত্য বসে বসে স্যালাইন খায়

ডায়রিয়া প্রকোপে কি যে জ্বলে যায়

নিধিরাম ডাক্তার

তার কাছে চলিও।

নিধিরাম সরকার আর দেখতে পারলেন না। কোনক্রমে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। তার দু’চোখ জ্বালা করা শুরু হয়েছে। মাথাতেও তীব্র ব্যাথা। তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন- এই চিন্তা করতে করতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

হপ্তাখানেক পার হয়েছে। আজ বুধবার।

আরেকটি মঙ্গলবার পার হয়ে গিয়েছে, কিন্তু নিধিরাম সরকারের জীবনে তেমন কোন মঙ্গল আসে নি। এ কয়দিনে তিনি অসংখ্যবার লিখতে বসেছেন, আর উঠেছেন। সৃষ্টি করেছেন আরও অদ্ভূত কিছু লেখনী, যাদের কবিতা বললে কবিসমাজকে জুতোপেটা করা হবে, যা তিনি কোনদিন লিখবেন ভাবেন নি। কোনদিন লিখতে চানও নি।

গত কয়দিনে লেখা নিধিরাম সরকারের কাব্যের(!) অংশবিশেষঃ

“পথে পথে পথিকের পদছায়া থেকে যায়

তামাকেও পুড়ে গেলে, ছাই তার রেখে যায়

কাল তার সুখস্মৃতি রক্ষণে অভিনব

দুঃখকে ঢেকে দেয় পাখিদের কলরব।”

এরপরেই লেখা-

স্মৃতি তাই হাতড়ে খুঁজে দেখি মন-প্রাণ

আমার ঘরেতে কেন মেথরের সন্তান?

শেষদিকে ব্যাপারটা আরও ঘন ঘন ঘটেছে। যেমন একটি কবিতায় প্রথম লাইন লেখার পরই তার মতিভ্রম-

বাহুবল দংশনে মনোবল বন্দী

প্রসাবের সহিত আজ, হাগুদের সন্ধি।

আগামীকাল বৃহস্পতিবার। নিধিরাম সরকারের জন্মদিন। অন্যান্যবার এইদিনটা তিনি বেশ ঘটা করে পালন করেন। বন্ধু আর পরিচিত কবিদের দাওয়াত দেন। খাওয়া দাওয়ার সাথে কবিতা নিয়েও অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু এবারে এসবের দিকে তার একেবারেই মন নেই। এরূপ অবস্থায় মন থাকা আসলে সম্ভবও না। নিধিরাম সরকার মন খারাপ করে ব্যালকনিতে বসে সামনের প্রসারিত রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকেন।

পরদিন।

বৃহস্পতিবার।

শিল্প-সংঘের মিলনায়তন লোকে লোকারণ্য। আজ মহান কবি নিধিরাম সরকারের শততম জন্মদিন এবং একই সাথে পঞ্চাশতম মৃত্যুবার্ষিকী। বক্তৃতার মঞ্চে যুগের শ্রেষ্ঠ কবি সুজয় বড়ুয়া যার বিখ্যাত কবিতা- “ পাখিদেরও মলমূত্র আছে”।

তিনি বলে চলেছেন-

“আমাদের আজ এখানে মিলনের হেতু আপনারা সকলেই জানেন। আজ মহান কবি নিধিরাম সরকারের শততম জন্মদিন এবং পঞ্চাশতম মৃত্যুবার্ষিকী। আপনাদের জন্য একটি সুসংবাদ হচ্ছে

আমরা গতকাল নিধিরাম সরকারের পরিত্যক্ত বাসা হতে তার একটি কবিতার খাতা উদ্ধার করেছি, যার সবকটিই অপ্রকাশিত।”

শ্রোতারা তুমুল হুল্লোড় করে উঠল। সুজয় বড়ুয়া একগাল হেসে আবার বলতে লাগলেন-

“সবচেয়ে অবাক করা যে বিষয়টি- পঞ্চাশ বছর আগেও তিনি আমাদের বর্তমান কবিতা কোন উচ্চতায় পৌঁছুবে তা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তার এ খাতার সব কবিতাই আমাদের বর্তমান কাব্যধারার সহিত একদম মিলে যায়। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এরূপ প্রকাশ ভঙ্গি আমাদিগের দ্বারাও সম্ভব হতো না।”

এরপর সুজয় বড়ুয়া তার অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠে নিধিরাম সরকারের একের পর এক নব্য উদ্ধারকৃত কবিতা পাঠ করে যেতে লাগলেন। আর শ্রোতারা অবিস্মরণীয় মুগ্ধতায় তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়ল।

একই সময়। পরলোক।

নিধিরাম সরকার কান ধরে জীবনানন্দ দাশের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। জীবনানন্দের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রচণ্ড রাগে তিনি উম্মাদপ্রায়। তিনি নিধিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“তোর হয়েছেটা কি বলত? কি শুরু করেছিস এসব? তুই কবিতাকে প্রচণ্ড ভালবাসিস, তোর প্রতিভাও অসাধারণ। মৃত্যুর এতদিন পরও তাই একই গতিতে একইভাবে লেখা চালিয়ে যাচ্ছিস। আমাদের আবার মৃত্যুর সাথে সাথে ওগুলোও গেছে। ছাঁইপাশ আর লেখা হয়ে ওঠে না। তাই বলে বোধটাতো আছে। কবিতার প্রতি সম্মানটা তো আছে, নাকি? তুই কি ভেবেছিস তুই এসব অসভ্য, অমার্জিত, অগ্রহণযোগ্য ভাষায় অবিরাম লিখে যাবি, আর আমরা কিছু বলব না? কি লেখছিস এসব? কেনই বা লিখছিস? বল, বল। সব খুলে বল এখুনি।”

নিধিরাম কোনমতে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এগুলো কেন লিখেছি আমি নিজেই জানি না দাদা। আসলে হয়েছে কি, সেদিন লাইব্রেরীতে গিয়ে বেশকিছু এ কালের কবিতা পড়েছিলাম। পত্রিকাতে দেখলাম এ কবিতাগুলো নাকি প্রচণ্ড বিখ্যাত। ওদের এইকালের ঐসব কবিতা না দাদা- ঠিক এরকম ধরণে লেখা।ওরা যেটাকে বলে- “আধুনিক কাব্য”। ঐ আধুনিক কাব্যের ভূত সেদিন থেকেই আমার মাথায় ভর করেছে। তারপর থেকেই এসব কিভাবে কিভাবে জানি লেখা হয়ে যাচ্ছে।”

জীবনানন্দ এবারে মুচকি হেসে দুঃখের সুরে বললেন,

“খবরদার আর ওসব পড়তে যাস নে। ওগুলো যতটা ভয়ংকর, ততটাই ছোঁয়াচে। আর ঐসব কবিদের কথাতো বাদই দিলাম।”

নিধিরাম জিভে কামড় দিয়ে তৎক্ষণাৎ বলল,

“ঐ কবিতা আরও পড়ব!!! মাথা খারাপ। কসম কেটে বলছি দাদা, ওগুলো লেখা তো দূরে থাক, জীবনেও আর ওসব ছোঁব না।”

বলেই নিধিরাম বসে পড়ে জীবনানন্দের পা জড়িয়ে ধরল। জীবনানন্দও পরম স্নেহে হাত রাখলেন

প্রাচীন ও আক্ষরিক অর্থেই আধুনিক কবিতার পরম সৌন্দর্যের পতাকাবাহী শেষ কবিটির মাথায়।


Recent Posts

See All
ভর্তাবিলাস

“এই বাল দেখানোর জন্য তুই আমাকে সাত কিলোমিটার হাঁটাইলি?” কথাটা মনে হয় না রফিকের কানে ঢুকলো। সে এমনভাবে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে ও...

 
 
 
বাগানবিলাস

১ এমন অদ্ভুত রঙের গোলাপ জাহিদ কখনো দেখে নি। ফুলের দোকানের সামনে প্রচুর ভীড় দেখে সে কৌতুহলে থেমেছিল, এবার কারণটা বুঝতে পারল। কালো-হলদু...

 
 
 
গতিসীমা পঁয়ত্রিশ

“স্যার, আপনার সাথে একটু আলাপ ছিল।” ইমন অবাক হয়ে তাকাল সামনের লোকটার দিকে। বয়স ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে কিছু একটা...

 
 
 

Comments


bottom of page