top of page

ক্ষুধাদ্বীপ

মেয়েটা বিস্কিটটা চায়ে ডুবিয়ে টুপ করে খেয়ে ফেললো। এই বাবু, তোমার নাম কি? চা-বিস্কিট। আমি ফিক্‌ করে হেসে ফেললাম। কি খাচ্ছো জিজ্ঞেস করি নি। তোমার নাম কি জানতে চেয়েছি। মেয়েটা মুখ তুলে হাসলো। এখানে যে যেটা খায়, সেটাই তার নাম। এতটুকুন মেয়ের এমন উদ্ভট রসিকতাজ্ঞান দেখে আমার চোখ কপালে উঠলো। তুমি তো ডেঞ্জারাস ফাজলামি করতে পারো। তোমার বয়স কত? মেয়েটা আবারো হাসলো। হাসিটা অদ্ভুত মিষ্টি। হাসতে হাসতেই বললো, তোমার নাম কি? আমি অদ্ভুত বিস্ময়ে অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও নিজের নাম মনে করতে পারলাম না। পাগল হয়ে গেলাম নাকি রে ভাই? মেয়েটার হাসি আরো বিস্তৃত হল। তবে তাতে কেমন জানি একটা দুখ দুঃখ মেশানো। কি এবার বিশ্বাস হলো তো? আমি ফ্যাকাসে চোখে তাকিয়ে থাকলাম। কি বলবো বুঝে উঠতে পারছি না।

আচ্ছা যাও তোমার কথায় নাহয় মেনে নিলাম। তাহলে তুমি একটু পড়ে যখন অন্য কিছু খাবে, ধর ঐ সামনের আপেল গাছ থেকে আপেল পেড়ে খাবে, তখন তোমার নাম চা-বিস্কিট থেকে আপেল হয়ে যাবে? মেয়েটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। এই মেয়ে অভিনয় করছে কিনা বুঝতে পারছি না। এইসব আজগুবি কথা সে যেভাবে নির্বিকারে বলে যাচ্ছে, এটা অভিনয় হলে এই মেয়ে ভবিষ্যতে হলিউড ফলিউডে চলে যাবে। আচ্ছা, তাহলে এই যে আমি এখন কিছু খাচ্ছি না, তাহলে আমার এখন কোন নাম নেই? আছে, তোমার নাম বাতাস। আমরা সবাই যখন কিছু খাচ্ছি না, তখন বাতাস খাচ্ছি। মেয়েটার বুদ্ধি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। যাই প্রশ্ন করছি কিছু না কিছু উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। উত্তরগুলা আজগুবি হলেও ইলজিক্যাল না। কিন্তু আমার নিজের নাম কেন মনে পড়ছে না! ধুর বাল! এ কি বিপদ?!

আচ্ছা ঐ যে দূরে এক পাল নেকড়ে একটা হরিণ খাচ্ছে। এদের সবার নাম তাহলে এখন হরিণ? আমি প্রশ্নটা করে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। এক পাল নেকড়ে আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যেই আয়েশ করে একটা হরিণ খাচ্ছে, এই দৃশ্য আমার কাছে তেমন অদ্ভুত লাগছে না কেন? এটা কি স্বপ্ন? নাকি আমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি? হ্যাঁ। এদের সবার নাম এখন হরিণ। মেয়েটার কথায় আমার সম্বিত ফিরলো। তুমি এরকম নির্বিকারে মিথ্যা কথা বলা কার কাছে শিখেছ বলতো? মেয়েটা এবার বেশ কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কখনো মিথ্যা বলি না। বিশ্বাস না হলে এদের হরিণ বলে ডেকেই দেখো না। আমি মুখের কাছে হাত নিয়ে জোরে ডাকলাম, হরিইইইণ। সবগুলো নেকড়ে একযোগে আমার দিকে ঘুরে তাকালো। দুই সেকেন্ডের মত যেন সময় স্থির হয়ে থাকলো। এরপর একসাথে পুরো নেকড়ের পাল আমার দিকে আসতে লাগলো। নেকড়েদের টিভিতে যেভাবে ছুটে আসতে দেখেছি ঠিক ততটাও দ্রুত নয়, কিছুটা যেন দুলকিচালেই আসছে এরা, জানে এই মোটকু আমি কখনোই এদের সাথে দৌড়ে পারবো না। আমি অসহায় চোখে চা-বিস্কিটের দিকে তাকালাম। ওহ না, এখন তার নাম শুধুই চা। সে বিস্কিট খেয়ে ফেলেছে। এই চা! কি বিপদ। এদের নাম তো একটু পড়ে মানুষ হয়ে যাবে। কি-কিছু একটা কর প্লীজ। চা বেশ নির্বিকার। যেন ভয়ের কিছুই নেই। নেকড়ে গুলো একদম কাছে চলে এসেছে। আমি এদের শিকারপূর্ব আনন্দকর ঘোঁত টাইপ শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এইসময় চা চেঁচিয়ে বলে উঠলো, গাজর।

নেকড়ে গুলো কড়া ব্রেক করলো। করেই ডানে তাকালো। সেখানে বসে একটা বয়স্ক লোক গাঁজর চিবুচ্ছে। সবগুলো নেকড়ে সেদিকে ছুট লাগালো। তু-তুমি কি করে করলে এটা? চা চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিল। বাতাস বললো, এই নামটা রিভার্স প্লেও করা যায়। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। বুঝিনি কি ঘোড়ার ডিম বললে। বুঝিয়ে বল। মানে তুমি যেই নাম বলবে, এরা সেটাই খাবে। তবে তুমি চব্বিশ ঘণ্টায় এটা একবারই ইউজ করতে পারবে। নেকড়ে গুলা লোকটাকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে। আমার গা গুলাচ্ছে। তু-তুমি আমাকে বাঁচাতে ওর নাম বললে কেন? ঐ লোকটা একটা খারাপ লোক। আমার সাথে খুব দুর্ব্যবহার করে। তোমার এখানে ভয় করে না? শুনে তো মনে হচ্ছে তুমি অনেকদিন ধরে আছো এখানে। হ্যাঁ, প্রায় মাসখানেক হয়ে গেল। আমার মত এখানে কেউ এতদিন টেকে না। ভয় প্রথম প্রথম করতো, এখন তেমন করে না। আমি চারপাশে আরেকবার ভাল করে তাকালাম। সবাই কিছু না কিছু খাচ্ছে। একটা সাপ কপ করে একটা ব্যাঙ খেয়ে ফেললো। একটা বিড়াল ইঁদুরের পিছে ছুটছে।

তুমি একমাস টিকে গেলে কিভাবে? আমার পায়ের আঙ্গুলে একটা ঘা ছিল। একটা হায়েনা আমাকে তাড়া করে আঙ্গুলে কামড়ে ধরে। হায়েনাটা নিজেই সাথে সাথে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। ও হয়তো আগেও অসুস্থ ছিল, কে জানে। এই থেকে আমাকে কেউ খুব একটা খেতে আসে না। আমি এই প্রথম লক্ষ্য করলাম বাতাসের পায়ের দুইটা আঙ্গুল নেই। এই জায়গাটা কোথায় বলতো! আর তুমি কি করে এখানে আসলে! আমি নিজেই বা কি করে এখানে আসলাম। কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এই জায়গাটা পৃথিবীর বাইরে। অনেকে ক্ষুধাদ্বীপ বলে। পৃথিবীতে যদি কেউ কখনো তোমার কাছে খাবার চায় আর তুমি না দিয়ে সেই একই দিনে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবারসীমা নিজে খেয়ে অতিক্রম কর, তাহলে এখানে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই সীমাটা সাধারণত অনেক। আমার মনে পড়লো গতকালকেই পিজ্জা হাটের অফার ছিল। যাবার পথে রেস্টুরেন্টের বাইরে এক খালি গায়ের নোংরা পিচ্চি আমার কাছে ভাত খাবার টাকা চেয়েছিল। রামধমক দিয়েছি। এরপর গুণে গুণে ১৭ স্লাইস পিজ্জা আর বোট্মলেস কোক খেয়েছি। হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। তুমি কি খেয়েছিলে? আম্মু একগাদা চকলেট আর আইস্ক্রিম এনেছিল। আমার ছোট এক সৎ ভাই আছে। ও অনেকবার চেয়েছে, এক্টুও দেই নি। ওর সামনেই সবগুলো খেয়ে শেষ করেছি। এই প্রথম বাতাসের চোখ ভেজা মনে হল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমার সারাশরীরে জানামতে কোন ঘা টা নেই। আমি এখানে একমাস কেন, একদিনও টিকবো না। অদূরেই একটা চিতা অনেক্ষণ ধরে লোলুপ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বাতাসের হাত ধরে চিতার নাম মানুষ হওয়ার অপেক্ষায় বসে রইলাম। চোখে ভাসতে থাকলো আমার ধমক খাওয়ার পর পিজ্জা হাটের সামনের ঐ পিচ্চির চোখের অদ্ভুত ব্যাথিত বিস্ময়

Recent Posts

See All
ভর্তাবিলাস

“এই বাল দেখানোর জন্য তুই আমাকে সাত কিলোমিটার হাঁটাইলি?” কথাটা মনে হয় না রফিকের কানে ঢুকলো। সে এমনভাবে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে ও...

 
 
 
বাগানবিলাস

১ এমন অদ্ভুত রঙের গোলাপ জাহিদ কখনো দেখে নি। ফুলের দোকানের সামনে প্রচুর ভীড় দেখে সে কৌতুহলে থেমেছিল, এবার কারণটা বুঝতে পারল। কালো-হলদু...

 
 
 
গতিসীমা পঁয়ত্রিশ

“স্যার, আপনার সাথে একটু আলাপ ছিল।” ইমন অবাক হয়ে তাকাল সামনের লোকটার দিকে। বয়স ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে কিছু একটা...

 
 
 

Comments


bottom of page