top of page

জন্মদিন

সে বছর প্রচুর বন্যা হল। এমন বন্যা যে আমাদের ঢাকার একতলা বাড়ির উঠানে হুটহাট ট্যাঙরা-কই চলে আসতে শুরু করল মাঝে মধ্যেই। আমার বয়স তখন নয়, মিলির বার। বন্যায় যখন বাড়ির বড়রা প্রচণ্ডভাবে অতিষ্ঠ, আমি আর মিলি যেন ঠিক ততটাই উদ্বেলিত। একদিন কই মাছ খালি হাতে ধরতে যেয়ে হাত কেটে রক্তারক্তি হল। যত না কাটাতে ব্যথা পেলাম, তারচে’ ঢের বেশি ব্যথা পেলাম মায়ের পিটুনিতে। মারটা আমি খেলেও আমার পাশে বসে সারারাত কাঁদল মিলি। মাছ ধরাতে তার উৎসাহই বেশি ছিল, দোষটা তাই সে নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছে। অন্যের দোষ ঘাড়ে নেয়াতে মিলির জুড়ি মেলা ভার।


আমার বাবা হাফিজুদ্দিন মুন্সির আর দশটা মধ্যবিত্ত পিতার মতই প্রয়োজনের চাইতে অধিক পরিশ্রমের বদভ্যাস আছে। অফিসে সামান্য চাকরি করলেও বাড়িটা যেহেতু আমাদের নিজের, দাদার কাছ থেকে পাওয়া, অফিসের টাকায় এ সংসার ভাল মতই চলে যায়। তবু বাবা প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায় বাড়ি ফিরেই দুই ঘণ্টা টিউশানি করেন। হয়তো সংসারে এমন অনেক খরচ আছে, যা চোখে দেখা যায় না। ন বছর বয়সে সেটা তো বুঝিই নি, যেহেতু নিজে এখনো সংসার করিনি, সেই বুঝ হয়ে ওঠে নি সেভাবে কখনোই। বাবা টিউশানি করায় অবশ্য সবচে’ বড় সুবিধা হয়েছে আমার আর মিলির। বাবার স্টুডেন্টরা বাবা অফিস থেকে ফিরে আসার ঘণ্টাখানেক আগেই চলে আসে। আমাদের এই বাড়িতে ছোট হলেও খুব সুন্দর একটা উঠান আছে। আর আছে পেয়ারা, আম আর কামরাঙা গাছ। সেই উঠানে আমি আর মিলি বাবার ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে চুটিয়ে বরফ-পানি, কুমির-ডাঙ্গা, বৌছি খেলতাম বাবা ফিরে আসার আগে পর্যন্ত।


একটু বড় হলে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাবা আমার জন্য রিকশা ঠিক করে দিলেন মাস চুক্তিতে। মিলিকে বাবা নিজে অফিস যাওয়ার পথে স্কুলে নামিয়ে অফিসে যেতেন। আমার একটু হলেও হিংসে হত। মনে হত মিলিকে যেন বাবা আমার থেকে বেশি ভালবাসেন। আমার সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিতেন রতন চাচা, বাবার ঠিক করে দেওয়া রিকশাওয়ালা। উনি আমাকে আদর করে বাবুভাই ডাকতেন।

“আরেহ্‌ বাবুভাই কি যে কন্‌ আফনে। মিলি হইতাসে মাইয়া। আফনে্‌ পুলা। মাইয়াগো একা একা চলন-ফেরনে রিক্স আছে না? এর লাইগা ওরে স্যার নিজে লইয়া যায়। আর কিছু না।”


রতন চাচা রিকশা চালাতে চালাতে টুকুর টুকুর করে অনেক গল্প করেন। আমরা বাসায় কি খাই, আমি আর মিলি কি খেলি, সেই খেলার নিয়ম কি, কে জেতে, আমাদের পড়ালেখার খবর; তার গল্পের যেন কোন শেষ নেই। মাঝে মাঝে তিনি নিজের পরিবারের গল্পও করেন। রতন চাচা রেলওয়ের ধারে বস্তির দুই-চালা এক ঘরে থাকেন। তার এক ছেলে, দুই মেয়ে। ছেলেটা নাকি বড্ড দুষ্টু। সারাদিন এর সাথে ওর সাথে মারামারি করে বেড়ায়। উনার এক মেয়ে অসুস্থ, তাকে নিয়ে রতন চাচা প্রায়ই খুব দুশ্চিন্তায় থাকেন।

আমার খুব ইচ্ছে করে রতন চাচার বস্তিতে একদিন যাই, উনার ছেলেমেয়েদের সাথে মন খুলে খেলি। বেশ কয়েকবার বলেছিও। রতন চাচাও মৃদু ম্লান হেসে বলেন, “দেখি স্যার অনুমতি দিলে একদিন লইয়া যামু আফনেরে বাবুভাই।”


মধ্যবিত্ত পরিবারে উৎসব পালনে আদিখ্যেতা থাকে না, থাকে আন্তরিকতা। আমাদের বাসায় প্রতিবছর আমার আর মিলির জন্মদিন খুব ছোট করে হলেও পালন করা হত। পাউন্ড কেক, চানাচুর, বিস্কিট। সাথে মা রাতে চালের আটার রুটি আর গরুর মাংস করতেন। অতিথি বলতে আশেপাশের দু’তিন বাড়ির আমার আর মিলির খেলার সাথী আর বাবার দু-একজন ছাত্রছাত্রীরা থাকতো। আর থাকতো রতন চাচা। রতন চাচা প্রতিবারই আমাদের জন্মদিনে খুব সুন্দর কিছু ফুল নিয়ে আসতেন।

“আমার তো ট্যাহা পয়সা নাই বাবুভাই, মিলিমণি। নাইলে সুন্দর-মুন্দর খেলনা কিনতাম আফনেগো লাইগা।”

আমরা দুজনেই একসঙ্গে বলতাম, যে কোন খেলনার চেয়ে আপনার এই ফুলগুলো অনেক সুন্দর রতন চাচা। মিলির জন্মদিন জুন ৩০-এ হওয়ায় সে অনুষ্ঠানে বাবা প্রায় কখনোই থাকতে পারতেন না। জুন ৩০ ব্যাংক ক্লোজিং, বাবার আসতে আসতে প্রায় রাত ৯টা বেঁচে যেত। মিলি প্রতিবারই বাবার উপরে একটু অভিমান করে থাকতো, বাবা সেই অভিমান ভাঙাতেন বাড়ি ফেরার সময় কোন জন্মদিনে হাতঘড়ি, কোনবার সত্যজিৎ এর গল্পের বই সাথে করে নিয়ে এসে।


রতন চাচা একবার সন্ধ্যেবেলা খুব হন্তদন্ত হয়ে আমাদের বাড়িতে আসলেন। তার দুচোখে ভয় এবং জল দুটোই দেখা গেল। “স্যার, ওরা আবার বাড়ির উফ্রে চইলা আইছে। স্যার কিছু করেন আফনে।”

বাবাকে দেখলাম খুব গম্ভীর মুখে মায়ের সিন্দুকে থাকা সাতহাজার টাকা নিয়ে রতন চাচার সাথে বেড়িয়ে যেতে। ফিরে এলেন ঘণ্টা দুয়েক পর। বাবাকে বড্ড ক্লান্ত দেখালো। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে বাবা? বাবা মুখে পানি দিতে দিতে বললেন, রতনের মেয়েটা হুট করে অসুস্থ হয়ে গেসিলো। হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসলাম। বাবা সাধারণত মিথ্যে বলেন না, কিন্তু তার এই কথা সত্য বলে মনে হল না আমার।


পরের বছর মিলির জন্মদিনে মা আমাকে মিষ্টি আনতে পাঠালেন। মিলি স্কুলে সেবার খুব ভাল রেজাল্ট করেছে তাই চানাচুর বিস্কিটের সাথে এবার মিষ্টিও থাকছে। মিষ্টির দোকান থেকে বেরিয়েই বাবাকে রিক্সায় উঠতে দেখলাম। অদ্ভুত। আজকে জুন ৩০, বিকাল চারটার সময় বাবার অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা না। বাসায় বলেই গেছেন ফিরতে রাত হবে। আমার মনে খটকা লাগায় অদ্ভুত এক কাজ করে বসলাম। একটা রিক্সায় উঠে বাবার পিছু পিছু গেলাম। বাবা হাতের ব্যাগটা পাশে রেখে একটা পার্কের বেঞ্চিতে যেয়ে বসলেন। আমি ঘড়ি দেখলাম। কারণ মিলির জন্মদিনের অতিথিরা ছয়টায় চলে আসবে, আমার তার আগে মিষ্টি নিয়ে পৌঁছতে হবে। ঠিক এসময় রতন চাচাকে দেখলাম একটা মেয়েকে নিয়ে বাবার দিকে এগিয়ে যেতে। বাবা পাশে রাখা ব্যাগ থেকে একটা কেক বের করলেন। পাউন্ড কেক না, রীতিমত পেস্ট্রি কেক। আমি মেয়েটার মুখ দেখার জন্য ঘুরে অন্যদিকে যেয়ে চমকে উঠলাম। মেয়েটা ঠিক মেয়ে নয়, বৃহন্নলা। কথ্য বাংলায় আমরা যাকে বলি হিজড়া।

“নুড়ি মা থাক্‌ তাইলে। স্যারের লগে আলাপ শেষ হইলে সোজা বাড়িত চইলা যাইস। এদিক ওদিক ঘুরিস ফিরিস না কিন্তু।”

বলে রতন চাচা পা বাড়ালেন, আমিও সট্‌ করে পার্ক থেকে কেটে পড়লাম।


আমি বাসায় পৌঁছলাম ছটার একটু আগে। আমার প্রায় সাথে সাথেই আসলেন রতন চাচা। কেক-টেক কাটার পর চালের আটার রুটি দিয়ে গোশত খেতে খেতে চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা নুড়ি কেমন আছে?

রতন চাচা খানিকটা হক্‌চকিয়ে গেল। আমি বললাম, ‘নাহ্‌ ও যে সবসময় অসুস্থ থাকে বলেছিলেন। তাই জিজ্ঞেস করছি।”

চাচা খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়েই জবাব দিল, “অহন একটু ভালা।”

রতন চাচা চুপচাপ একমনে খেয়ে চলেছেন। আমি আড়চোখে রিক্সা চালাতে চালাতে রোদে পুড়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে আছি। চাচার চেহারার সাথে মিলির চেহারার অদ্ভুত মিল। ঠিক যেমনটা নুড়ির সাথে বাবার।


Recent Posts

See All
ভর্তাবিলাস

“এই বাল দেখানোর জন্য তুই আমাকে সাত কিলোমিটার হাঁটাইলি?” কথাটা মনে হয় না রফিকের কানে ঢুকলো। সে এমনভাবে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে ও...

 
 
 
বাগানবিলাস

১ এমন অদ্ভুত রঙের গোলাপ জাহিদ কখনো দেখে নি। ফুলের দোকানের সামনে প্রচুর ভীড় দেখে সে কৌতুহলে থেমেছিল, এবার কারণটা বুঝতে পারল। কালো-হলদু...

 
 
 
গতিসীমা পঁয়ত্রিশ

“স্যার, আপনার সাথে একটু আলাপ ছিল।” ইমন অবাক হয়ে তাকাল সামনের লোকটার দিকে। বয়স ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে কিছু একটা...

 
 
 

Comments


bottom of page